DEHLIJ

মজিদ মাহমুদ

 চল্লিশের বাংলা কবিতা : প্রেমে বিপ্লবে

মজিদ মাহমুদ

 


বিশ শতকের চল্লিশের দশক সময়কালকে আধুনিক বাংলা কবিতার যুগসন্ধিক্ষণ বললে অত্যুক্তি হবে না। ইংরেজ শাসনসুবাদে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যে আধুনিকতার সূচনা হয়েছিল এবং ওই একই শতকের মাঝামাঝি মধুসূদন দত্ত তার অনুসারীবর্গের দ্বারা বাংলা কবিতার যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল; যার ধারাবাহিকতা রবীন্দ্র-নজরুলে এসে পূর্ণাঙ্গ বিকাশ এবং তিরিশে যা চূড়ান্ত সাবলিমিটি অর্জন করেছিল-প্রকৃত প্রস্তাবে চল্লিশে এসে যার ব্যাপক বিকাশ নতুন কোনো পথে তার মুক্তির উপায় অনুসন্ধান করছিল। কথা আমাদের জানা আছে, বাঙালির সঙ্গে ইংরেজের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মধ্যযুগের গুটি কেটে বাঙালি যে নতুন চিন্তার সূচনা করেছিল-তা যতই বেনিয়াকরণের দ্বারা দষ্ট হোক না কেন তা নতুন চিন্তার উপর জয়-ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছিল। অতীত অভ্যস্ততা এবং নতুনের প্রতি প্রবল বিরাগ সত্ত্বেও আধুনিকতার প্রবল তোড়ে মধ্যযুগের কাব্যধারাকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে যে আধুনিকতার সূচনা হয়েছে তা মোটেও আকস্মিক নয়। বঙ্কিমের রচনা সূত্রে কিংবা একাডেমিক আলোচনার মাধ্যমে আমরা জেনে এসেছি-বাংলা সাহিত্যে যুগসন্ধিক্ষণের কবি হিসাবে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনিই মধ্যযুগ আধুনিক যুগের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ রচনা করতে পেরেছিলেন। এটা ঠিক মাইকেলের মহাকাব্যধর্মী রচনা বাদ দিলে ঈশ্বর গুপ্তের - কবিতা পরবর্তী কালের গীতি কবিতার পূর্বসূরিত্ব দাবি করতে পারে। বিশেষ করে কবিতায় সমকালকে ধারণ ছিল ঈশ্বর গুপ্তের অন্যতম প্রধান কীর্তি। ইংরেজ সিভিলিয়ানদের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, দেশি এলিটদের হিন্দু কলেজ নারী শিক্ষার জন্য বেথুন কলেজের অভিঘাত পুরোনো বিশ্বাসকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আর সেই চ্যালেঞ্জকে কবিতায় মোকাবেলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। ঈশ্বর গুপ্ত মানুষটার স্বভাবও ছিল অনেকটা যুগসন্ধিক্ষণের। একই সঙ্গে তিনি ইংরেজের মদ মাংসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন; অন্যদিকে হিন্দুয়ানির প্রতি তার ছিল সহজাত আকর্ষণ।

সে যাই হোক, চল্লিশের দশকের যুগ সন্ধিক্ষণের সঙ্গে এই সময়টির একটি প্রতি মিল আবিষ্কার নিঃসন্দেহে সাহিত্যের ছাত্র অধ্যাপকরা ভালো চোখে দেখবেন না। তবু কাল কবিতার প্রতি একটু গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে তারা ঠিকই বুঝতে পারবেন যে, দেরিতে হলেও আগের ঘটনার প্রায় একশত বছর পরে রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি দর্শন আমূল পরিবর্তন হচ্ছে। আলোচনায় আমি খুব বেশি দূর যাব না, শুধু একটি বিষয় স্মর্তব্য, গত শতকের চল্লিশ দশকে বাংলা সাহিত্য রাজনীতির ইতিহাসে যে সন্ধিক্ষণের আবির্ভাব ঘটেছিল তারও চরিত্র ছিল একশো বছর আগে আবির্ভূত সন্ধিক্ষণের মতো কারণ। কারণ, উনিশ শতকের সূচনাপর্ব ছিল ভারত তথা বাঙালির ইংরেজিকরণের কাল আর বিশ শতকের চল্লিশের দশক ছিল বাঙালির বিইংরেজিকরণের কাল। সময়টিতে বাঙালি জীবনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যার একটি ফল ছিল প্রত্যক্ষ যে, সমুদ্র পাড়ের ইংরেজ শাসন আর কোনোভাবেই ভারতে স্থায়ী হচ্ছে না। দৌর্দ- বণিকের যে মানদ- রাজদ- পরিণত হয়েছিল এই দশকেই তার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তির ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। নতুন একটি স্বাধীন দেশের কল্পনা তখন। নিঃসন্দেহে এদেশের কবিকুলকে আবিষ্ট করে রাখবে এটিই স্বাভাবিক। এই সময়ে আর যে সব দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা ঘটেছিল-যার অভিঘাত থেকে নিস্তরঙ্গ বাঙালি জীবনেরও কোনোমুক্তি ছিল নাতার অন্যতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। একই সঙ্গে ডারইউইনের বিবর্তনবাদ, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ আর বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কার বিশ্বের মানব মনে এক নতুন যুক্তিবাদের সূচনা করছিল। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে মানব গোষ্ঠী এক নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তাহলো কাল মার্কসের মতবাদকে অনুসরণ করে একটি শোষণমুক্ত সমবণ্টিত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আর স্বপ্ন দেখা তখনই কেবল সম্ভব হচ্ছিল যখন উপনিবেশবাদের আপত অবসান এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা এগিয়ে যাচ্ছিল। চল্লিশের সময়কালটি যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মেরুকরণের কারণ ঘটছিল যা ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। মানুষের কল্যাণ মারণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকাশ সময়টিতে সাধিত হয়েছিল। বিশেষ করে একটি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত না শুকাতেই প্রলয়ঙ্করী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছিল। এই সময়ে মানব সভ্যতা তার চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। একদিকে ছিল জর্মানির নির্বিচারে ইহুদি নিধন অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। এহেন পরিস্থিতিতে পূর্বে গড়ে ওঠা স্বতঃসিদ্ধ হাইপোথিসিস ক্রিয়াশীল থাকা সম্ভব ছিল না। মানব সভ্যতা যে সব মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল-এই সময়-পরিধিতে তা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু মানবের সকল শুভবোধের চেতনা তখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। বরং, এসময় পৃথিবীব্যাপী এক নতুন আদর্শায়নের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। একদিকে প্রবল পুঁজিবাদ অন্যদিকে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র সারা দুনিয়া জুড়ে এক অস্থির সময়ের জন্ম দেয়। চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতা এক নতুন চেতনা নির্মাণের পথে এগুতে থাকে। বর্তমান আলোচনায় দশকের কয়েকজন কবির রচনাশৈলী দর্শন নিয়ে ত্বরিৎ কিছু আলোকপাত করা হলো।

 

এক

এক সুভাষ মুখোপাধ্যায় জন্মেছিলেন রুশ বিপ্লবের (১৯১৭) দুবছর পর আর সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মের (১৯২৬) আট বছর আগে, ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগর মাতুলালয়ে; পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের দর্শনায়-সেবছরই বিদ্রোহী কবি (তখনও বিদ্রোহী খ্যাতি অর্জন করেননি) কাজী নজরুল ইসলামের ব্যাপকভাবে কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ। সুভাষ সম্বন্ধে কিছু বলতে এই পরিচয়টুকু অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ সুভাষের কবিতা থেকে মাকর্সবাদ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, জেল-জুলুম আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। যে কারণে তার পূর্বসূরি এবং সতীর্থ নির্বাচনের বিষয় সাহিত্যের সমকাল শিকড়ায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হতে পারে। তার পূর্ববতী বিশেষ করে তিরিশের কবিদের জীবনবোধ কাব্যিক লড়াই থেকে সুভাষের সংগ্রাম ছিল সম্পূর্ণই আলাদা। তিরিশের কবিরা যে কাব্যবৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন, সুভাষ কখনো তার কবিতায় সেই পরিধি স্পর্শ করেননি। তিরিশের প্রধান পরাক্রমশালী কবিদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা রুচিবোধের জায়গার বাইরে থেকে সুভাষ বেড়ে উঠেছিলেন; এমনকি মার্কসবাদী বিষ্ণু দে কিংবা সমর সেন থেকেও আলাদাভাবে। বিষ্ণু দে মাকর্সবাদী হয়েও রাবীন্দ্রিক লড়াইয়ে নিজেকে সর্বদা ব্যাপৃত রেখেছিলেন। হয়তো সে কারণেই তিনি কবিতার ভাষায় উপমায় কখনোসাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারেননি। তাছাড়া তিরিশের অপরাপর কবিদের মতো তার মধ্যেও ছিল তারুণ্যে রাবীন্দ্রিক শুচিবায়ুগ্রস্ততা। আলাদা হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা। আর পুরোমাত্রায় কলাকৈবল্যবাদী; মাকর্সবাদের সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল বিষয়-সর্বস্ব চিন্তার দিক থেকে উদার সামন্তবাদী। তিনি যে বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন তার ব্যবচ্ছেদের অর্থ দাঁড়ায় উদারসামন্তবাদী চেতনার কল্যাণ রাষ্ট্র, যার পরিচালনায় ছিলেন নব জাগ্রত শিক্ষিত জনতা-মূলত উনিশ বিশ শতকে ঔপনিবেশিক শাসনের উপজাত হিসেবে যার আবির্ভাব। মূলত ভারতবর্ষে মার্কসবাদ নেতৃত্ব শ্রেণি কিছুটা ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যে কারণে কৃষি শ্রমজীবী শ্রেণির নেতৃত্বের বদলে জমিদার-বুর্জোয়া পাতিবুর্জোয়া শ্রেণির তরুণরা মার্কসবাদের প্রতি ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। উৎপাদনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন না। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির কাছে খুব একটা সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। বিষ্ণু দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ চোরাবালি (১৯৩৭) আর সুভাষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক (১৯৪০)-এর প্রকাশকাল মাত্র তিন বছরের ব্যবধান। অবশ্য তাদের জন্মের ব্যবধান প্রায় একদশক। কবিখ্যাতিও বিষ্ণু দে সুভাষের চেয়ে আগে উপভােগ করছিলেন। বিষ্ণু এবং সুভাষ উভয়ে মার্কসবাদে দীক্ষা নিলেও এই দুই মাকর্সবাদীর সম্পর্ক কখনো এক মেরুর নয়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিরিশের কবিদের যে টানপোড়েন ছিল; রবীন্দ্র ব্যবসা শিখিনি বলে পাঠককে সতর্ক করে দিয়ে আলাদা কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা-সেখানেও আলাদা কিছু দেখাতে না পারা এবং পরিণামে রবীন্দ্রনাথে স্থিত হওয়া- সবই তিরিশের প্রায় সাধারণ বৈশিষ্ট্য, এমনকি বিষ্ণু দে মার্কসবাদী হয়েও ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন, রবিকরোজ্জ্বল এই দেশে, ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ। সব গুণ কীর্তনের পশ্চাতে অবিশ্বাসের একটি বীজ এবং পাপ বোধ হয়তো কাজ করেছিল। যে কথা বুদ্ধদেব বসুও বলেছিলে-“আমাদের নিন্দুকেরা যতই সংখ্যায় তেজে বর্ধিষ্ণু হতে লাগল, আমাদের আনন্দ ততই যেন উজ্জ্বল হলো-লোকে নিন্দা করলেও আনন্দ হয় এতই ছেলেমানুষ তখন ছিলাম আমরা।

শেষ তিরিশের সমর সেনের সঙ্গেও সুভাষের কাব্য মেজাজের বিস্তর পার্থক্য ছিল। যদিও সমর সেনের কাছ থেকে মাকর্সিজমের হ্যান্ডবুক পড়েই তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভালো করে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। জন্ম সালের দিক থেকে সমর সেন (১৯১৬) সুভাষের সর্বাধিক নিকটতর হলেও সমর সেনের মানসিক সাযুজ্য ছিল অপরাপর তিরিশের কবিদের সঙ্গে। তবে আধুনিক মানসের ক্লান্তি সংশয় বিবিক্তি তাকে আক্রান্ত করলেও শ্লেষ ভাষার সহজ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি কবিতাকে তীক্ষè করে তুলেছেন। প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি। সুভাষের হাতে যা আরো তীক্ষè হয়ে ওঠে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় তিরিশের হুযুগ কাব্যিক উন্মাদনা থেকে কিছুটা বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছাত্র হিসেবে প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও একইভাবে প্রতিষ্ঠান শাসিত এলাকা থেকে না আসা এবং নানাবিধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলার ভেতর দিয়ে কাব্য মার্কসবাদী আন্দোলনকে একই সমান্তরালে স্থাপন করে সুভাষের কাব্যযাত্রা। সুভাষসহ চল্লিশের অপরাপর কবি মিলে মার্কসবাদের আলোকে বাংলা কবিতাকে পরিস্ফুটিত করে তুলেছেন। তার সমকালীন কিংবা অব্যবহৃত পরের সতীর্থ মাকর্সবাদী যিনি কৈশোরেই বাংলা সাহিত্যে পূর্ণতা দান করে বিদায় নিয়েছিলেন সেই সুকান্ত ভট্টাচার্যও (১৯২৬-১৯৪৭) স্মরণীয়। আর ক্ষেত্রে নজরুলের পূর্বসূরিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করাও প্রয়োজন কেননা নজরুলই ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে প্রথম অপ্রাতিষ্ঠানিক মাকর্সবাদী, যিনি সাম্যবাদী দল এবং সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাছাড়া নজরুল এবং তার বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ ভারতবর্ষে মার্কসবাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন। নজরুল ভারতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম গতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও নজরুল দীক্ষিত মার্কসবাদী ছিলেন না। আর যে কারণে তার সাহিত্য কখনো পরিশুদ্ধ মার্কসবাদী সাহিত্য নয়। সমাজ জীবনের নানাবিধ সঙ্কট সম্ভাবনা তাঁর কবিতার অনিবার্য বিষয় হয়ে এসেছে। মানব জীবনের সামগ্রিক বিবেচনায় যার মূল্য অপরিসীম। ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যাপারে আরো বলা যায়, নজরুল জীবনের বিচিত্র ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ায় তিরিশের কবিদের মতো রবীন্দ্রনাথ কিংবা অপর কোনো একক ব্যাপারে তার মনোসংযোগ ঘটাতে পারেনি। তিনি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বাধা এবং সম্ভাবনাকে তার কবিতার উপাদান করে তুলেছেন। এবং জীবনের প্রতি অপরিসীম আগ্রহের কারণে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে যাবতীয় শিল্পবাসনা নিজস্ব সম্পদে রূপান্তর করেছেন। শৈশবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি তার অনুরাগ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত আত্মস্থ করার কারণে তাকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের হাফেজ বলা হতো। আজীবন রবীন্দ্রমুগ্ধ রবীন্দ্র অনুরাগী হয়েও কবিতায় এবং জীবন যাপনে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে বসবাস এবং স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করতে পারা ছিল নজরুল প্রতিভার অসাধারণ ঘটনা।

নজরুল ছাড়াও পরবর্তী কালে রাজনীতি কবিতার জন্য সুভাষকেও জেল খাটতে হয়েছে। সুতরাং সুভাষের বাংলাকাব্যের পূর্বসূরিত্ব কেবলমাত্র নজরুরের জীবন-যাপন আদর্শ উদ্দেশ্যে এমনকি ভাষার যোগাযোগের অবস্থানের দিক থেকেও কিছুটা সম্পর্ক নির্ণয় করা যেতে পারে। তবে চল্লিশ দশকের যে উত্তালকালে সুভাষ কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন সেটি ছিল সমাজ ওচল্লিশের বাংলা কবিতা: প্রেমে বিপ্লবে ৩৭ রাজনীতির ক্ষেত্রে আদর্শয়ানের কাল। চল্লিশের অপরাপর কবি যেমন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণ কুমার সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ মার্কসবাদে স্থিত হয়েছিলেন কিংবা মানবীয় অনুপ্রেরণা দ্বারা জারিত ছিলেন। সে অর্থে সুভাষের মাকসীয় দর্শন। গ্রহণ কোনো বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল না। সেটা ছিল সে সময়েরই দাবি। এমনকি যারা মার্কসবাদে স্থিত হননি কিংবা মার্কসবাদের সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতি বিশেষ করে ধর্মকে সাংঘর্ষিক মনে করেছিলেন তারাও তাদের মতো করে আদর্শ প্রচার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ক্ষেত্রে চল্লিশ দশকের ফররুখ আহমদ উল্লেখযোগ্য। জীবনের শুরুতে তিনিও ছিলেন মার্কসবাদে বিশ্বাসী। পরবর্তী কালে ইসলামকেই অন্বিষ্ট জেনেছেন। তবে ফররুখেরও স্বপ্ন ছিল শোষণহীন কল্যাণ রাষ্ট্র। যার আদল তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ইসলামের প্রথম যুগে খলিফাদের আমলে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক (১৯৪০) কিছুটা তাড়াহুড়ো করে প্রকাশিত হয়, মাত্র একুশ বছর বয়সে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের বয়সের হিসেবটিও একই ছিল। তবে সুভাষের ক্ষেত্রে কিছুটা তাড়াহুড়ো এই জন্য হয়েছিল যে বুদ্ধদেব বসু তখন আধুনিক কবিতার সংকলন প্রকাশের চেষ্টা করছিলেন আর সেই সংকলনের অন্তর্ভুক্তির প্রথম শর্ত ছিল কবির অবশ্যই প্রকাশিত গ্রন্থ থাকতে হবে। আর বয়সে তরুণ হলেও সুভাষের মতো প্রতিশ্রুতিশীল কবি বাদ দিয়ে বুদ্ধদেব বসু সংকলন করতে চাননি। তবে তাড়াহুড়ো হলেও সম্পূর্ণ আলাদা এবং পরিপক্বতা নিয়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে পেরেছিল। এবং একটি মাত্র গ্রন্থ দ্বারাই তিনি সমকালীন বাংলা কবিতায় প্রাতিস্বিক হয়ে উঠেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্য থেকে সুভাষের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যেতে পারে : ‘একটি বাঙালি ছেলে যে বয়ঃসন্ধি সময়েও প্রেমের কবিতা লিখলেন না, ঘটনাকে সম্পূর্ণ নঙর্থক বলে উড়িয়ে দেয়া চলে না। ...কেউ যেন মনে না করেন আমি এমন ইঙ্গিত করছি যে প্রেমের কবিতা না লেখার মধ্যেই প্রশংসনীয় কিছু আছে; বরং আমি এটাই আশা করবো যে কোনো সামাজিক অবস্থাতেই প্রেমের কবিতা লিখতে আমরা ভুলব না। আমি বলতে চাই যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম প্রকৃতি অনুপস্থিত একটি সামাজিক লক্ষণ। হয়তো দুর্লক্ষণ... এখন আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যখন বাঙালি কবির হাতেও কবিতা আর শুধু বীণা হয়ে বাজছে। না, অস্ত্র হয়ে ঝলসাচ্ছে। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকলেও এটি সত্য, তরুণ যুবকের মনোমিথস্ক্রিয়ায় আবেগের যে ঘটনা কবিতা লেখার প্রাথমিক উপাদান হয়ে আসে, সুভাষের জন্য তা এসেছিল একটু ভিন্ন পথে। বাংলা কবিতায় যা ছিল সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরে। নজরুল এবং তার পূর্বসূরিদের অনেকেই অন্যায় অত্যাচার এবং সামাজিক বঞ্চনাকে কবিতা করে তুলেছেন। কিন্তু তাদের রোমান্টিক মন প্রেম ব্যাহত হয়েই মূলত বিদ্রোহে উদ্দীপিত হয়েছিল সে কথা বলা যায়। হয়তো সুভাষের ক্ষেত্রে একই ধরনের মিথস্ক্রিয়া কাজ করলেও তিনি প্রথমে একেবারেই সে পথ মাড়াননি। তবে তাই বলে কথা সত্য নয়। যে সুভাষ প্রেমের কবিতা রচনা করেননি। মানব প্রেমের ফল্পধারা তার কবিতার অন্তঃপ্রবাহে বিরাজমান। তাছাড়া যে সব সময়ের সন্তান একদিন জীবন এবং কবিতাকে অভিন্ন রেখে মিছিলের মুখে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের হৃদয়ের প্রেম এবং জীবন যাপনের উপাদানগুলো একই সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে উন্নততর জীবনের স্বপ্ন বিস্তার করে জনসমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে নেমে এসেছিল।

আজকের মন মেজাজের মধ্য দিয়ে সুভাষের কবিতা আস্বাদন করা পুরোটা সম্ভব নয়। সুভাষের কবিতা পাঠের জন্য তৎকালীন ইতিহাসের নিবিষ্টতা দাবি রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরের বছর ১৯৪০ সালে সুভাষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আগেই বলা হয়েছে রুশ বিপ্লব আর সুভাষ সমান বয়সী। প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল গ্রাস এবং মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে সুভাষের শৈশব কৈশোর বেড়ে ওঠা। ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বহুদেশ তখনো ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্পেষণে দলিত। ফ্যাসিবাদের উত্থান, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ধর্ম জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে ভয়াবহ বিভাজন মানব অস্তিত্বকে নিরস্তিত্ব করে তোলে। তাই মার্কসবাদ ভিন্ন তরুণদের কাছে মুক্তির আর কোনো উপায় এমনভাবে আকর্ষিত হতে পারেনি। পরবর্তীকালে স্বপ্নভঙ্গ হলেও মার্কসবাদে দীক্ষা তখন অনিবার্য ছিল। এমনকি সুভাষ নিজেও যখন ১৯৮৩ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৯২ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণ করেন তখন সুভাষভক্তরা প্রশ্ন উত্থাপন না করে পারেন না। পরিণামে তারা আবিষ্কার করেন গণতান্ত্রিক পুঁজি বিকাশের সঙ্গে সমন্বয়ী রাজনীতির। তার ব্যাপারে দলবদলের অভিযোগও এসেছে জোরেসোরে। দিন বদলের সঙ্গে তার জীবন কবিতা পাল্টেছে অভিযোগ অস্বীকার করা যাবে না। এবং পরবর্তীকালে তিনি একজন ক্ষয়িষ্ণু মাকর্সবাদী হিসেবেই টিকে ছিলেন। তবে কথা ভুললে চলবে না, সুভাষকে। আমাদের দেখতে হবে প্রথম পর্বের মাকর্সবাদী সুভাষের ভেতর থেকে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে কর্মময় জীবনে যার পরিসমাপ্তি। একই সিদ্ধান্ত বৃত্তাবদ্ধতা অনেক সময় জীবনে গতিহীনতার নামান্তর। সাহিত্য কেমন হবে তার অনিবার্য দিক নির্দেশ সব সময় সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিলেন, ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদ এবং যুদ্ধবিরোধী সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ গঠিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ-এর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে বিষ্ণু দে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মনোনীত হন। যুদ্ধ বিরোধিতা রবীন্দ্রকাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও রবীন্দ্রনাথের পরিবর্তনগুলো অনেক সময় আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। জীবন সায়াহ্নের ঘটনা পর্ব এবং অনুজের বৈপ্লবিক চেতনা প্রবাহ রবীন্দ্রমানসও সক্রিয় হয়ে ওঠে। হয়তো সযতœভাবে একটি মার্কসীয় সংকলন তাঁর কবিতা থেকেও সম্পাদন করা সম্ভব।

সুভাষ মার্কসবাদে স্থিত হয়ে সাহিত্য রচনা করলেও তার ভাষা এবং রচনা-শৈলী বাংলা কাব্যে আলাদা মাত্রা বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বাংলা ভাষার সহনশীলতা বিষয়ের সম্প্রসারণ তার কবিতার প্রধান অবদান। সুধীন্দ্রনাথ এবং বিষ্ণু দেসহ রবীন্দ্রানুসারীত্বের মাধ্যমে বাংলা কবিতা যে ঐতিহ্য পথে অগ্রসর হচ্ছিল সুভাষের কবিতা সেই যাত্রাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে। কবিতার ভাষা নিয়ে বিষ্ণু কিংবা বুদ্ধদেব বসু যে কিছুটা শ্লাঘা বোধ করতেন সুভাষ তার মুক্তি দিলেন। কবিতার ভাষাকে তিনি নজরুলের পর আবার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নামিয়ে আনলেন। যে কারণে তার কবিতা যোগাযোগের ক্ষমতা হারায় না। সমকালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেও সুভাষ বাংলা কবিতার মূল ধারাকেই সমৃদ্ধ করে তোলেন।

সুভাষের কবিতা কেবল কবিতা পাঠের আনন্দের জন্যে নয়; নয় কেবল মাকর্সবাদের ইতিহাসের কাছাকাছি যাওয়া, সুভাষের কবিতা আমাদের পড়তে হয় মানুষের ভেতরের মানুষটিকে, মিছিলে যে সব মুখ হারিয়ে যায় তাদের চকিতে এক ঝলক দেখে নিতে এবং কথাগুলো কিভাবে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তা দেখার জন্যে।

সুভাষের কবিতা মানুষের মুখের ভাষা থেকে আলাদা করা যায় না। বাংলা কবিতায় তখনো যা ছিল না, সুভাষ তা সংযোজন করেছেন। সাধারণ লোক যে ভাবে কথা বলে সেই কথার মধ্য থেকেই সুর ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। বাংলা কবিতার ক্লাসিক ফর্মটি তিনি গ্রহণ করেননি। তবে এও সত্য সুভাষের সব সাধারণ কথাই ছিল প্রকৃষ্ট ছন্দের দৃষ্টান্ত। সব কথাকেই তিনি। ছন্দের ছকে ফেলে চারণ কবির মর্যাদা আধুনিক কবিতার অবয়বে খোদাই করে দিয়েছেন। প্রবাদ প্রবচন স্লোগান সবই তার কবিতায় অঙ্গীভূত হয়ে সাধারণকে অসাধারণ; এবং যা প্রতিদিনের তা চিরদিনের করে তুলেছে। মুখের ভাষাই তার কবিতা এবং তার কবিতাই মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে।

সুভাষ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিকের প্রথম কবিতা দিয়েই মানুষের মুখের কবিতে পরিণত হয়েছিলেন। বিপ্লবকে মানুষের মাঝে সঞ্চারিত করে দেওয়ার অভয়মন্ত্র তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।

                প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

                ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,

                চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য

                কাঠ ফাটা রোদ সেঁকে চামড়া

সুভাষই প্রথম বাংলা কবিতাকে ফুলের ভাবালুতা থেকে আলাদা করার কথা বলেছিলেন। তার সতীর্থ সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো তিনিও চাদের উপমা দিয়েছেন- তন্বী চাদ ক্রোড়পতি ছাদের সোফায়। আর ফুলের ব্যাপারে বলেছেন:

                ফুলকে দিয়ে

                মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই

                ফুলের ওপর কোনো দিন আমার টান নেই।

                তারচেয়ে আমার পছন্দ আগুনের ফুলকিÑ

                যা দিয়ে কোনোদিন কারোমুখোশ হয় না। পাথরের ফুল]

 

দুই

ফররুখ ছিলেন বলা চলে সুভাষের বিপরীত মেরুর কবি। তিনি একজন শুদ্ধরূপের রোমান্টিক কাব্য নির্মাতা না একজন ইসলাম বিশ্বাসী বাঙালী মুসলমান কবি? তার কালের সামাজিক রাজনৈতিক পট বিচার না করে ফররুখ সাহিত্যের কৃত মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব অসম্পূর্ণ।

একটু অন্যভাবে বিবেচনা করা যায়, ফররুখ আহমদ যা বলতে চেয়েছিলেন তাঁর সমকালে তার আর কীভাবে বলা সম্ভব ছিল? তখন ফীদের বর্বর সভ্যতার বিরুদ্ধে বৈষম্যহীন মানবতাবাদী সাহিত্য রচনার প্রধানত দুটি পথ খোলা ছিল, যথা মস্কোমুখী বৈষম্যহীন সমাজ এবং মক্কামুখী শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষাবলম্বন করা। দুটি পথের গন্তব্য ছিল প্রায় অভিন্ন-দুটির লক্ষ্য ছিল শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। তবে সোভিয়েট ইউনিয়নে সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রোলেতারিয়েত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি আধুনিক শিক্ষিত সুধীজনের দৃষ্টি বেশি আকৃষ্ট ছিল। দুধারার মাঝামাঝি একটি উদার মানবতাবাদী ধারা যে ছিল না, তা নয়। মার্কসবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দী অতিক্রম না করতেই মার্কস কোথাও অপসৃত, কোথাও প্রশ্নবিদ্ধ। আর ইসলাম প্রায় দেড় হাজার বছর অতিক্রম করা সত্ত্বেও অন্তত তার আধ্যাত্মিক কারণে অনেক প্রশ্নকেই এখনও পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। তবে অপ্রয়োগ হয়েছে সর্বত্র, এমনকি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর মাত্র চল্লিশ বছর না যেতেই ইসলাম তার মাঙ্গলিক বা কল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় কাঠামোটি হারিয়ে ফেলে। ঔপনিবেশিক শাসনে নিষ্পেষিত ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য সেই হাজার বছর আগে মরুভূমিতে প্রতিষ্ঠিত স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন দেখা পুনরায় শুরু হয়েছিল। তবে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সাংগঠনিক রূপ ছিল বলে মনে হয় না। যারা পাকিস্তান কেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে ছিলেন কিংবা যারা গীতার কর্মবাদ উপনিষদের আধ্যাত্মিকবাদকে রাষ্ট্রযন্ত্রে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তারা পরিণামে ছিলেন জাতীয়তাবাদী। সৎ কবির পুঁজি কোনো মতবাদ এমনকি কবিতাও নয়, মানুষ। সেই মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ফররুখ আহমদ ভেবেছিলেন। কিন্তু মার্কসবাদী বলি, আর ফররুখের ইসলাম শুভ রাষ্ট্রই বলি, দুটোই ছিল তখন সমকালীন বিষয়। ইসলামের চিরকালীনতা শাশ্বতরূপ প্রশ্নহীন হলেও, ফররুখ আহমদ কিন্তু সমকালীন প্রপঞ্চে প্রভাবিত হয়ে কাব্য রচনা করেছেন। কারণ ব্রিটিশ থেকে আলাদা হবার কালে কারও ধারণা মুসলমানদের ঐক্য সেই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। ফররুখের আগে কিংবা পরে কোনো কবির জন্য এই বিষয়টি প্রাসঙ্গিক ছিল না। সুতরাং, একটি নিরপেক্ষ এবং নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানের মধ্যে তার বিষয়গুরুত্ব স্থাপন করতে পারলে তার কাব্যের রসাস্বাদন সহজ হতে পারে। ফররুখ আহমদ বাংলা কবিতার চল্লিশ দশকের এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। ফররুখ সারাজীবন তাঁর কাব্যে শৃঙ্খলমুক্ত পূর্ণচিত্তে জীবন-মৃত্যুর পরিপূর্ণসুর তুলেছেন।

 

তিন

বাংলাদেশের কবিতাকে তিনি ধাতৃত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কাব্য এবং কাব্যের সংজ্ঞা দুটিই তিনি নির্মাণ করেছিলেন। কাব্যের ক্ষেত্রে নির্মাণ শব্দটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। কবিতা কেবল আবেগ এবং স্বতঃস্ফূর্ততার বাহন নয়; তিনি আমাদের কাব্যাঙ্গনে প্রথম ধারণাটি প্রাতষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু করেছিলেন। তিনি বলতেন, আবেগ যদি চিন্তার দ্বারা সমর্থিত না হয় এবং বুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত না হয়, তবে সে আবেগ কুহেলিকা সৃষ্টি করতে পারে, জীবনের সম্ভাবনা জাগাতে পারে না। একটি ভালো কবিতা যে কবির কঠোর পরিশ্রম দক্ষতার ফসল কথাও তিনি বারবার বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কবিতা শব্দের শিল্প। তাই কবিকে শব্দ প্রয়োগে কুশলী হতে হয়। একজন ডাক্তার এবং প্রকৌশলী যেমন তার তত্ত্ব প্রায়োগিক বিদ্যায় অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন তেমনি একজন কবিকেও শব্দ প্রয়োগের কৌশল এবং দক্ষতা অর্জন করতে হয়। যদিও সবই তিনি শিখেছিলেন পাশ্চাত্যের কবিদের কাছে; বিশেষ করে কোলরিজের কবিতার ক্ষেত্রে ইবংঃ ডড়ৎফ রহ ঃযব নবংঃ ড়ৎফবৎ থিওরি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তিনি কীটসের কাছে শিখেছিলেন আমি ক্ষণকালও কবিতা ছাড়া বাঁচতে পারিনা- অর্ধদিনও নয়, সম্পূর্ণ দিন তো নয়ই। এসব কথা আমাদের কবিরা বিশেষ করে তিরিশের দশকের কবিরা বলতে এবং প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার প্রয়োগ অভ্যাসটি তখনো গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে আজকে আমরা যাকে বাংলাদেশের কবিতা বলি। তিরিশের দশকে বুদ্ধদেব বসু বাংলা কবিতার জন্য যে কাজটি করেছিলেন, পরবর্তী দশকে সৈয়দ আলী আহসান সেই কাজটি করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর কাজটি ছিল প্রায়োগিকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি তিরিশের কবি বিষ্ণু দে চেয়ে ১২ বছরের আর আর তার পরবর্তী সমর সেনের চেয়ে বছরের ছোট ছিলেন। ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব আর আবুল হোসেন তাঁর বয়স্য। কিন্তু বাংলাদেশের কবিতার পথ নির্মাণ এবং নির্দেশে তার গুরুত্ব অন্যদের চেয়ে কিঞ্চিৎ আলাদা এবং অনস্বীকার্য। তিনি যে শব্দের কথা বলেছিলেন, নানা পরিবর্তন রূপান্তরের মধ্যে তিনি কবিতার সেই সহ্য ক্ষমতা প্রমাণ করেছিলেন। ইসলামি ঐতিহ্য নিয়ে তিনি কবিতা শুরু করলেও অল্প দিনের মধ্যেই পাশ্চাত্য কবিতার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। কবিতার বিষয় থেকে তিনি সরে আসেন এমনকি নির্মাণ কৌশল থেকেও; আর কারণে তিনি বাংলাদেশের পঞ্চাশের আধুনিক কবিদের অগ্রপদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। আমার পূর্ববাংলার মতো একটি কবিতা তিনি রচনা করেছিলেন। আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ অন্ধকারের তমাল শব্দ যে কীভাবে অপরিহার্য অবিনাশী হয় তার প্রমাণ তিনি এখানে করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আধুনিক বাংলাদেশের এটিই ছিল শব্দচিত্র। প্রাণ আকুল করা শব্দরাজি। তিনি বলতেন কবির কর্তব্য হচ্ছে নৈমিত্তিক ক্ষেত্র থেকে, সাধারণ বাস্তবতা থেকে জীবনকে উদ্ধার করে এনে শব্দের জগতে তাকে প্রাণবন্ত চঞ্চল করা। তিনি একজন ভাষাবিজ্ঞানীর মতো কাজ করেছেন। কবিতার ক্ষেত্রেও যে শব্দকে প্রমাণ করা যায় তিনি তার উদাহরণ রেখেছেন। তিনি মনে করতেন ভাষা শব্দ জাতির চৈতন্যোদয়ে কুশল সম্ভাষণ। যেমন আমাদের দেহের ত্বক শরীরের সঙ্গে স্বাস্থ্য, জীবন স্পর্শের অনুভূতি নিয়ে সক্রিয়, তেমনি আমাদের ভাষা শব্দ আমাদের জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে বিজড়িত। তিনি মনে করতেন ভাষা হলো জাতির ওষ্ঠ লালিত জীবনের কাকলি। তিনি ভাষার মধ্যে জাতির অস্তিত্ব পরিচয় বিধৃত করতে চেয়েছিলেন। ভাষা ছাড়া একটি জাতিকে আলাদা করে চেনার আর কোনো একক মাধ্যম নেই। যে জাতি যত বড় তার ভাষা সাহিত্যের প্রসারতাও তত ব্যাপ্ত।

যদিও তাঁর কালের বাঙালি মুসলমানের মতো তাঁরও পরিচয়ের সূত্রটি গড়ে উঠেছিল ধর্মকে আশ্রয় করে। ধর্মের মাধ্যমেই তিনি অপরাপর বিরোধপূর্ণ পরিবেশ থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন। ধর্মের সৌন্দর্যকে সাহিত্যের উপাদান করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যে সময়ের দীনতার মধ্যে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রাথমিকভাবে বাইরে আসার আর কোনো রাস্তা ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনের শেষপাদের বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমানের স্বকীয়তার লড়াই; মজ্জায় প্রবাহিত বাবুকালচার আর তার জন্মের মাত্র তিন বছর আগে বলশেভিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ইউটোপিয়া। সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন সময়ের সন্তান সব সংঘাত তাঁকে যথাযথ স্পর্শ করে গিয়েছিল। ভাঙন আর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলে প্রাতিস্বিক। তিনি চিন্তার গোঁড়ামির ক্ষেত্রে মূলানুগ ছিলেন না বলে অনেকেই তাঁর আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু এটিকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? যে চাহার দরবেশ থেকে কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ঘাটে তিনি তরী বেঁধে নিশ্চিত থাকেননি। যেমন তাঁর সতীর্থদের অনেকেই শুরুকেই জীবনের শেষ মহার্ঘ্য মনে করেছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে হিজরত করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর নাম ভোগীদের দলে ছিলেন না। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ হিসাবে জাস্টিফাই করেছিলেন। তাঁর কাছে জীবনের প্রগাঢ়তা, কর্মমুখীনতা, গতিশীলতা এবাদতের মতো ছিল।

আজকে বাংলা কবিতা যে পথে এগিয়ে চলেছে তা মূলত তিরিশের ধারাকে অনুসরণ করে। আমদের কবিতায় এই ঔপনিবেশিক ধারাটি জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা তখন আমাদের কবিতা অনুপ্রাসের বিতর্ক ছেড়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেনি। তাঁর মতেযে পৃথিবীতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে গেছে এবং যেখানে মানুষের পদক্ষেপ অর্থহীনতায় যেন উৎসর্গীত সেখানে কবিতার শৃঙ্খলিত সুরে সম্মােহন কি করে আসে? সেখানে কবিতা বিচিত্র ভঙ্গুর শব্দ চূর্ণে উদ্দেশ্যহীন সমস্বর।

সৈয়দ আলী আহসান আমাদের সাহিত্যে দিক নির্দেশনা করলেন কীভাবে কবিতা পড়তে লিখতে হয়। তিনি চর্যাপদের ধারভাষ্য রচনা করলেন। তিনি মধ্যযুগের গহ্বর থেকে রোসাং রাজসভা থেকেপদ্মাবতীকে উদ্ধার করে আনলেন ১৯৬৮ সালে। ১৯৭৩ সালে উদ্ধার করলেন মধুমালতীকে। তিনি পঞ্চদশ শতকের অবধি কবি কুতুবনেরমৃগাবতী অনুবাদ সম্পাদনা করেন। তিনি মধ্যযুগের পা-ুলিপি অনুবাদ পাঠ নির্ধারণের তুলনামূলক রীতির প্রবর্তন করেছিলেন।

 

চার

বাংলা কবিতার প্রবল আদর্শায়নের যুগে, ভারত বিভাগের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে--সেই উনিশশো সাতচল্লিশ সালে আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রচ্ছদে ছবি আঁকছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন-তখন জয়নুল বলতে উনপঞ্চাশের মন্বন্তর, বিদ্রোহী ধেনুর দড়ি ছেড়ার আকাক্সক্ষা, সাওতালিনীর জীবন-যে কোনো উপনিবেশিত বাঙালিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। নজরুলীয় প্রবল অভিঘাতের পরে তিরিশ দশকে বাংলা কবিতা মেধা মননে যখন কিছুটা স্থিত হয়ে আসছিল- ঠিক তখনই ভারত তথা বাঙালির আসন্ন স্বশাসন পুরো পরিস্থিতি উদ্বেলিত করে তুলছিল। বিশেষ করে রাজনীতিক ওয়াকিবহাল মহলের এই আশঙ্কা ঘনীভূত হয়ে উঠছিল যে, উপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও যে পদ্ধতি মসনদে জারি হতে যাচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের মুক্তি ঘটবে না। এই মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কবিদের অনেকেই মার্কসবাদকে অন্বিষ্ট জানছেন; একই সঙ্গে আদি ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা মানুষের বৈষম্য ঘুচাতে পারে বলেও দু'একজন প্রতিভাবান কবির বিশ্বাস প্রবল হচ্ছে। এই সময়ের বিপরীত মেরুর দুই প্রতিভাবান কবির নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফররুখ আহমদ। তাদের সময়টি তারা প্রবলভাবে শাসন করলেও বয়স্যদের কেউ কেউ আলাদা কাব্যিক ভূখ- নির্মাণে মেধা মননে দেদীপ্যমান হয়ে উঠছেন-আহসান হাবীব নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম প্রধান। যিনি বাংলা কবিতার বিপুল সম্ভার তিরিশ পঞ্চাশের দশকের কবিতা কর্মের মধ্যে নিভৃতে সেতুবন্ধনের কাজ করেছেন। রাজনৈতিক সমাজ পরিবর্তনের আদর্শিক চেতনায় দীক্ষিত না হয়েও যিনি তার স্পর্শকাতর মন দিয়ে প্রতিপার্শ্বিক জগৎ নির্মাণ করেছেন। চল্লিশের আদর্শবাদী কাব্যধারার সঙ্গে আমরা নজরুল তার অনুসারীদের অধিকতর মিল খুঁজে পাই। বাংলা কবিতায় দ্রোহ সংগ্রামের আবহটি পরবর্তীকালে তৎপর থাকলেও ছন্দোবদ্ধ কবিতার বাগাড়ম্বরতা মিলিয়ে যায়। ফলে বাংলা কবিতা আলোচনার ক্ষেত্রে একটি প্রক্ষিপ্ত ধারণা আহসান হাবীবের প্রতি আরোপ করা না গেলেও কথা বলতে হয়, ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যিক বলয় তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে-যা আজ কিংবদন্তির মতো সত্য।

চট করে আহসান হাবীবের কবি প্রতিভা নিয়ে মন্তব্য করার ঝুঁকি অনেক। যে যৎসামান্য আলোচনা তার সম্বন্ধে জারি আছে, তার সবটাতেই তাকে মৃদুভাষী কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি বিদীর্ণ দর্পণে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। অর্থাৎ আহসান হাবীবকে পাঠক যতটা প্যাসিভ মনে করেন, তিনি মোটেও তা নন। কবির এই প্রতিবাদ থেকে আমরা তাঁকে পুনর্গঠিত করতে চাই-এমন নয়। তবে তাঁর মৃদুভাষিতার মধ্যে দ্রোহ কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল সুবিধা মতো আমরা তার কিছু ইঙ্গিত দিব।

ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে আহসান হাবীবের পরিমাপকতা এখন আর কোনো আলোচনার বিষয় নয়। বলা চলে, সাহিত্য সম্পাদকদের খরা মৌসুমে তিনি এখন এপিকের চরিত্রের মতো দুর্দান্ত সজীব আলাদা। এখন সাহিত্যের অভিভাবকত্বের জন্য এমন। কেউ কোথাও নেই-যেখানে সাহিত্যের যশোৰাথী শিক্ষার্থীরা নিজেকে মেলে ধরতে পারে। কারণ অধিকাংশ দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীরসম্পাদকরা নিজেরাই এখনো তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে দ্বিধান্বিত। যাক, আহসান হাবীবের কোনো আলোচনা কেবল তার পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কারণ গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতার উল্লম্ফনতার যুগে তিনি নিরলসভাবে নিজের ধারায় কাজটি করে গেছেন-যা পরবর্তী দশকগুলোর কাব্যকর্মের ভিত্তি রচনায় কিছুটা সক্রিয় ছিল। তিনি যে সহকর্মীদের সঙ্গে ঢাকার সাহিত্য নির্মাণে কাজ শুরু করেছিলেন-তারা ঠিক পরবর্তীকালের কবিতার উপর আহসানের মতো ধারাবাহিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। অবশ্য প্রকাশের কাল বিবেচনায় পঞ্চাশের প্রবল পরাক্রান্তদের আগে তার মাত্র দুএকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি প্রথম কাব্য প্রকাশের প্রায় পনের বছর পরে তার দ্বিতীয় গ্রন্থছায়াহরিণ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৬২ সালে, পাকিস্তান পর্বে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী কবিদের উপর তার প্রভাবের দাবি পুরোপুরি ধোপে টেকে না। কিন্তু কথা ঠিক কবিতার নিরলস পথিক হিসেবে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের পথে তিনি প্রবল পদচারণা করেছেন। আর সেটি- বাংলা কবিতার বর্তমান ধারা, যার দৃশ্যযোগ্য পরিবর্তন হলেও প্রবল অস্বীকারের মাধ্যমে নব নির্মিতি হয়নি।

এবার আহসান হাবীবের কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আগেই বলেছি, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থরাত্রিশেষ প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষবর্ষে-হয়তো শেষ মূহূর্তে। প্রথম প্রকাশিত বইয়ের কোনো কপি আমার কাছে না থাকায় ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। ১৯৮০ সালে মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণটি আমার ভরসা। তার আগেও ১৯৫৫ সালে গ্রন্থটির একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। তখনো কবির দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশের মুখ দেখেনি। তৃতীয় সংস্করণেও প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে শিল্পাচার্যের প্রথম প্রকাশের চিত্রকর্মটি। তবে সংস্করণে কবির একটি ভূমিকা থাকায় প্রথম প্রকাশ সম্বন্ধে আমরা কিছু তথ্য জানতে পেরেছি। কবির জবানিতে- বলা যাক, আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে রাত্রিশেষ-এর প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল কোলকাতায়। রাত্রিশেষে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, কোলকাতার কমরেড পাবলিশার্স-এর প্রথম প্রকাশনা। ১৯৪৭-এর মাঝামাঝি সময়ে তারা রাত্রিশেষ বের করেন। আমি কেন গ্রন্থটি প্রকাশের সময়ের প্রতি জোর দিচ্ছি তা এখন বলব। বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ইংরেজ বিদায় নেওয়ার ঠিক প্রাক্কালে কবি গ্রন্থটি প্রকাশ করছেন। আমরা জানি বাংলা সাহিত্যের দুটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসন্ধ্যাসংগীত প্রভাতসঙ্গীত কাব্যদ্বয়কে রবীন্দ্রযুগের একটি বাঁক বলা হয়। এমনকি কবিতা হিসেবে প্রথম সফলতা বললেও দোষ হয় না। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের যে ধারার কবিতার সঙ্গে আমরা পরিচিত তার সূত্রপাত এই গ্রন্থের কবিতার মধ্যেই অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নাম হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সন্ধ্যা কিংবাপ্রভাত নতুন নয়। চর্যাযুগের ভাষাকে -িতরা সান্ধভাষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার অন্যতম কারণ এটি প্রকৃতির আলো আঁধারির সময়। দিন রাতের সন্ধিক্ষণ-কোনো কিছু নিশ্চিত করে বলা যায় না।

আহসান হাবীবের কবিতা গ্রন্থের নাম রাত্রিশেষ হলেও এর অর্থের দিকটি প্রভাতসঙ্গীতের মতো। কবি যদিও একটি সন্ধিক্ষণের মধ্যে আছেন; তবু সে সন্ধিক্ষণের অবসান দিবালোকের মতো সত্য। অসতর্ক পাঠে সব সময় মনে হবে আহসান হাবীবের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ কবিতায় প্রবল হয়ে এসেছে। মনে হবে আত্মরতির মগ্ন-চৈতন্যের কবি তিনি। কারণ বয়স্যরা যখন শ্রেণিহীন একটি সুখী সমৃদ্ধ সময়ের স্বপ্ন দেখছেন। ভাবছেন, এতদিন পরদেশী শাসন ছিল বলে সকল দুঃখ গ্লানি তাদের গ্রাস করেছিল। এখন নিজের দেশটিকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতে হবে। বণিক স্বার্থের তীক্ষ নখরের কাছে ছেড়ে দিলে হবে না। আহসান হাবীব সেখানে তার ব্যক্তিগত দিনগুলোর কথা তুলে ধরছেন।

                দিনগুলি মোর বিকলপক্ষ পাখির মতো

                বন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণ্যমান।

এলিয়টীয় বন্ধ্যামাটির রূপকল্প গৃহীত হয়েছে তাঁর কাব্য ভাবনার শুরুতে। যৌবনের প্রচ- স্বপ্ন কামনা সত্ত্বেও বোদলেয়ারীয়পঙ্গুতা ব্যর্থ বাহুবিথার তার একই কবিতায় হতাশার নখর ঘষ্টানির ক্ষত। একই সঙ্গে বিষ্ণু দের ঘোড়সওয়ারের মতো তিনি বলেন-মনের অশ্ব হ্রস্ব চরণ বঞ্চনা-বিক্ষত। আবার তার দিনগুলি আজ রাবীন্দ্রিক রোম্যান্টিক চেতনায় উজ্জ্বল দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। প্রকাশ ভঙ্গিতে রয়েছে সুধীন্দ্রীয় নিখিল হাহাকার। কিন্তু এর সবগুলো মিলেই তিনি শুরুতেই হয়ে উঠেছেন স্বকীয় আহসান হাবীব-যিনি বাংলা বিশ্ব কবিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি। যিনি নিজের স্বকাল স্বদেশ বর্ণনায় দারুণ সৎ। আহসান হাবীবের একক কোনো রাজনৈতিক দর্শনের কথা শোনা না গেলেও কমরেড প্রকাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি যখন তার; এবং তার কবিতা যখন দেশ মাটি সংলগ্ন ভাবনার আধার তখন তো বলতেই হয়- কবি রাজনীতি সচেতন না হয়ে পারেন না। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতাএই মন-এই মৃত্তিকা কবিতাতেই কবি বলছেন, তীক্ষ নখর উদ্যত যার তারে ভালোবাসলাম/ দুনয়নে যার হিং¯্র আগুন আজো জপি তার নাম। রবীন্দ্রনাথের জীবন সায়াহ্নের আকাড়া দর্শনসত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। আহসান হাবীব শুরুতেই অগ্রজের অভিজ্ঞতাকে জীবনের পাথেয় করে তুলছেন। বুদ্ধদেব বসুসুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে বলেছিলেন-‘একটি বাঙালি ছেলে যে বয়ঃসন্ধি সময়েও প্রেমের কবিতা লিখলো না, ঘটনাকে সম্পূর্ণ নঙর্থক বলে উড়িয়ে দেয়া চলে না। আহসান হাবীব সম্বন্ধে কথা খাটে না সত্য। কারণ তিনি সারা জীবনে অনেক প্রেমের কবিতা লিখেছেন। এমনকি মৃদুভাষী প্রেমের কবি হিসেবে খ্যাতিও পেয়েছেন। কিন্তু এই খ্যাতি যেমন কবি অবিমিশ্র পেতে চাননি; তেমনি আমাদেরও কথাÑ তার কবি জীবনের শুরুটা একেবারে প্রেম দিয়ে, রোমান্টিক ভাবালুতা দিয়ে শুরু হয়নি। সমকালীন আর পাঁচজন বিপ্লবী তরুণ কবির চেতনা প্রকাশের কৌশল ধারণ না করলেও তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে দেশ-কাল ঘনিষ্ঠ কবিতার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। তাছাড়া তার প্রথম গ্রন্থটির নামের মধ্যেই রয়েছে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ। উপনিবেশিত দেশের সময়কে তিনি যে রাত্রির সঙ্গে তুলনা করছেন তার প্রমাণ আছে এই গ্রন্থে। রেড রোডে রাত্রি শেষ কবিতায় তিনি বলছেন :

                এরা সেই আপনি গড়া খেয়া নৌকায় হয়তোÑ

                পেরিয়ে যাবে গঙ্গা

                মিলিয়ে যাবে পশ্চিম সীমান্তে,

                নদীর জলে ঝলকে উঠবে মুক্তি,

                বন্যা আসবে রেড রোডের প্রান্তে

                                কেন না

                এদিকে আবার জাগবে নতুন সূর্য!

এবার তাঁর সম্বন্ধে চালু তথাকথিত মৃদুভাষিতার অভিযোগের জবাব খুঁজব কবির জবানিতে। কবি যে কাব্য গ্রন্থে নিজের মুখোমুখি হয়েছেন তার নামবিদীর্ণ দর্পণে মুখ-যেখানে তার জীবন কবি হওয়ার অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। গ্রন্থের প্রথম কবিতাপরিক্রম এবং অবস্থান। প্রসঙ্গ-যেখানে কবি বলছেন :

তারপর ক্রমান্বয়ে ছায়া হরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দুহাতে দুই আদিম পাথর এবং প্রেমের কবিতা। শ্রেণি বৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদ্বাস্তু উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা এই সবই আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু। এক শ্রেণির মানুষের কৃত্রিম জীবন তৃষ্ণা তাদের নীচ জীবনাচরণের প্রতি ব্যঙ্গবাণ-এই সব। সুধীজনদের কেউ কেউ বলেন, বলতে বলতে চালু হয়ে গেছে, আহসান হাবীব মৃদুভাষী কবি। কবিতায় মৃদুভাষিতা কি জিনিস আমি কিন্তু বুঝতে পারি না। ভালো কবিতা আর মন্দ কবিতা বুঝি, সার্থক রচনা আর অসার্থক রচনা বললে বুঝি।

আহসান হাবীব সম্পর্কে আরেকটি কথা বলার আছে। তাঁর নিজের কবিতার কথা কমবেশি উল্লিখিত হলেও তিনি যে কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে একটু বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছিলেন, কথা আহসান হাবীবের পাঠকদের কাছে খুব একটা শুনি নাই। কথা বলা জন্য জরুরী যে, তার সমকালীন বড় কবিদের অনেকেই কাজটি সফলভাবে করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন-প্রত্যেকেই শিল্পে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর হুয়ান র্যামন হিমেনেথেরপ্লাতেরো এ্যান্ড আই এবং শাহেদ সোহরাওয়ার্দীরএসেজ ইন ভার্স-এর অনুবাদ খসড়া নামে প্রকাশিত হয়। হিমেনেথ ছিলেন আধুনিক কালে স্পেনের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। ১৯৫৬ সালে তিনি কবিতার জন্য নোবেল পান। আহসান হাবীব ছাড়া আমাদের দেশে তার আর কোনো অনুবাদ আমার চোখে পড়েনি। আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অগ্রজ শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পা-িত্যের কথা আমরা অনেকেই জানি। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন- তাও অজানা নয়। কিন্তু তিনি নিজেও যে একজন বড় মাপের কবি ছিলেনÑ সে কথা আমরা অনেকেই জানি না আহসান হাবীব নিজের গরজে এই অনুবাদ কর্ম সম্পাদন করে বাংলা কবিতার পাঠককে কিছুটা এগিয়ে দিয়েছেন।

 

পাঁচ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশের রাজত্ব শেষ হবার প্রায় এক দশক আগে কবি আবুল হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ নব-বসন্ত রচনা প্রকাশিত হলেও নানা কাল মানচিত্রের পরিবর্তন সত্ত্বেও এখনো তাঁর সত্তর বছরের দীর্ঘ কাব্যপরিক্রমা সজীব সৃষ্টিশীল। বাংলাদেশের কবিতার বিবর্তনের ইতিহাস রচনায় এবং বাংলা কবিতায় আবুল হোসেনের কর্তৃত্বের দাবিপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর কাব্যজীবনারম্ভের সালতামামিটুকু জানা প্রয়োজন। আবুল হোসেন এত দীর্ঘদিন বাংলা কবিতাকে অতি নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ পরিবর্তনের সঙ্গী হয়ে আছেন-যা অনেকের জন্য আজ ইতিহাসের বিষয়। বাংলা কবিতার এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি কাব্যযাত্রা শুরু করেছিলেন যখন রবীন্দ্রনাথের প্রভাববলয় এক দুর্লক্ষ্মীয় মিথে পর্যবসিত হয়ে ছিল এবং যা ভাঙার জন্য বাংলা কবিতার নতুন টাইটানরা গলদঘর্ম হয়ে ছুটছিলেন। আবুল হোসেন সেই বিদ্রোহী-তিরিশের পরবর্তী প্রজন্ম হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনানন্দ দাশের ধূসর পা-ুলিপি প্রকাশের মাত্র দুই বছরের মধ্যে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। ছাড়া বিষ্ণু দে- ঘোড়সওয়ার (১৯৩৮), সুধীনন্দ্রনাথ দত্তের অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া (১৯৩৮)’ প্রকাশকালও একই সময়ে। প্রসঙ্গে সমর সেনের নাম খুবই প্রাসঙ্গিক। কেননা আবুল হোসেনের প্রথম কাব্যরচনার কালপর্বে তার কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭) এবং গ্রহণ অন্যান্য কবিতা (১৯৪০) প্রকাশিত হচ্ছে। উল্লিখিত কবিগণ যখন নানা কসরতে নিজেদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করবার প্রবল চেষ্টায় রত তখন বিষয় মাহাত্ম রোমান্টিক চেতনা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমর সেন কবিতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছেন; আর এখানেই আবুল হোসেনের সঙ্গে রয়েছে তাঁর দারুণ মিল। কারণ বাঙালি মুসলমানের কবিতার ইতিহাস তখনো কাজী নজরুলকে অতিক্রম করে নবধারা তৈরিতে সক্ষম হয়নি। এমনকি চল্লিশ দশকে বাংলা কবিতায় আবুল হোসেনের সতীর্থ আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ সৈয়দ আলী আহসান কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে আবুল হোসেনের উত্তরসূরিত্ব বরণ করে নিয়ে ছিলেন। তাছাড়া প্রবল শক্তিশালী এই কবিগণ যে পথে হেঁটেছেন আবুল হোসেনের পথ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই বাংলাদেশের কবিতার জন্য আবুল হোসেনের এই ভূমিকাটুকু বাইরে রাখা সমীচীন নয়; কারণ পরবর্তী কালে ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা কবিতার ইতিহাস নির্মাণে তার অগ্রগামিতা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।

বাংলা কবিতায় আবুল হোসেনের গুরুত্ব আরো যে কারণে উল্লেখ্য-তা হলো তিরিশ পঞ্চাশ দশকের কবিতার মধ্যে প্রথম মেলবন্ধ হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে চল্লিশের কবিরা যে আদর্শবাদিতার দ্বারা তাদের কবিতার মাহাত্ম নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, আবুল হোসেনের কবিতা তার থেকে সতর্ক দূরত্ব রচনা করে চলেছিল। তার এই সতর্কতার নেতিবাচকতা আমাদের পীড়া দিলেও সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার নির্মেদ শিল্পসৌকর্য নির্মাণের অন্তঃপ্রবাহে তিনি কাজ করে চলেছেন নিরন্তর। তবে ১৯৪০ সালে ১৮ বছরের তরুণ কবি বাংলা কবিতার ঐতিহ্য থেকে আলাদা হয়ে নতুন কোনো বাতিঘর তৈরি করেছিলেন দাবি নিরর্থক। তার গ্রন্থে ছিল সরাসরি রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের কাব্যগ্রন্থগুলো এবং তিরিশের বিশেষ করে বিষ্ণু সুধীন্দ্রনাথের প্রবল উপস্থিতি। কিন্তু আমাদের বলার বিষয় বাংলা কবিতার সমৃদ্ধিকালে তিনি আঙ্গিক নির্মাণে পুরাণাশ্রয়ী না হয়ে ঠিক নতুন সৃষ্ট পথকে চিনে নিতে পেরেছিলেন। আর তার এই পথ পাকিস্তান পর্বের বাংলা কবিতাকে-যা পরবর্তী কালে স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতা-তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সক্রিয় ছিল।

আবুল হোসেনের কবিতা জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় কথা তিরিশ পরবর্তী বাংলা কবিতার সঙ্গে এখনো তার নিবিড় সখ্য। যার ফলে নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের শিল্পবোধের পরিবর্তনকে কালোপযোগী করে তুলতে পেরেছেন। দীর্ঘ যে কোনো সাহিত্যিকের দীর্ঘ কাব্যকর্ম সেই ভাষা সাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে- আবুল হোসেন তার প্রমাণ। আবুল হোসেনের কবিতার মধ্য তাই আমরা লক্ষ্য করি একটি ঐতিহাসিক ধারাক্রম; কবিতার শিল্প সৌকর্যের বিবর্তন পরিবর্তনের পাশাপাশি তিনি কালের কণ্ঠস্বরকেও আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। এবার আবুল হোসেনের কবিতা থেকে সরাসরি কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করা যাক। আগেই বলা হয়েছে, আবুল হোসেন প্রথম কাব্যগ্রন্থে নিজের প্রাতিস্বিকতা পুরোপুরি প্রমাণ করতে পেরেছেন এমন নয়; কিন্তু কাব্যে দেখার বিষয় হলো, তিনি সমকালীন কাব্যভাষা বিষয়ের সঙ্গে রীতিমত সম্পৃক্ত এবং কোনোভাবেই এই গ্রন্থে তিনি প্রাচীন কোনো কাব্যকলাকে সঙ্গী করেননি। রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের কাব্যগ্রন্থগুলো, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন এক সার্থকতার সঙ্গে তাকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছেন; আর এই বোধকে সম্বল করে তিনি হয়ে উঠছেন প্রাতিস্বিক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম নবযুগ কবিতার মধ্যে সমকালীন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর এবং বিষয় নির্বাচনেরও ইঙ্গিত মেলে। এমনকি সতীর্থ গোলাম কুদ্দুসের মতো দীক্ষিত মার্কসবাদী না হওয়া সত্ত্বেও মার্কসীয় কবিদের পরিভাষা তার প্রথম পর্যায়ের কবিতায় আভাষ মেলে। যদিও খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়, শুরুতে যখন তিনি নবযুগ লেখেন তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যখন বাংলার মেয়ে লেখেন তখন রবীন্দ্রনাথের পত্রপুট, যখনডাইনামো লেখেন তখন জীবনানন্দ দাশ, যখনঘোড়সওয়ার রেখেন তখন বিষ্ণু দে- কবিতা সমানে চলে আসে; কিন্তু এসব কবিতা কীভাবে শুরুতেই আবুল হোসেনীয় হয়ে উঠেছিল তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক:

                অদূরে পথের পাশে অবিরাম সুরে

                ডাইনামো একটানা দ্রুত ধ্বনি তোলে।

                শহর গভীর ঘুমে নিস্তব্ধ নিঝুম,

                সে শব্দ কাঁপন তোলে শাখায় পাতায়,...

                ট্রামের ঘর্ঘর ধ্বনি থেমেছে এখন,

                আকাশ আঁধারে ঢাকা মৃত্তিকা নিসাড়

                জেগে জেগে আমি শুনি নিশিথের বুকে

                আর কোন হৃদয়ের তুমুল ক্রন্দন

সবচেয়ে বড় কথা আবুল হোসেন শেষ পর্যন্ত কারো কাব্যবলয়ের মধ্যে অবস্থান করেননি। এমনকি যাত্রারম্ভের পরে দীর্ঘ কাব্যবিরতি দিয়ে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বিরস সংলাপ প্রকাশিত হয় একেবারে পাকিস্তান পর্বের শেষপাদে। আর সে ক্ষেত্রে একটি সন্দেহ থেকে যায়, প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় তিরিশ বছরের দীর্ঘ বিরতিতে কীভাবে আমরা তাঁকে বাংলাদেশি কবিতা নির্মাণে একনিষ্ঠ কর্মী বলতে পারি? কারণ ততদিনে ঢাকায় পঞ্চাশের কবিদের এক নতুন কাব্যযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে, দীর্ঘ বিরতিতে আবুল হোসেনের চিৎকর্ষে যে কাব্যবৃত্ত গড়ে উঠেছিল তা দিয়ে পঞ্চাশের কবিদের খুব বেশি বাঁধতে পারেননি; কিন্তু তিনি যে কাব্যকলা সৃষ্টি করলেন তা সম্পূর্ণ আবুল হোসেনীয়- যা তার আগের গ্রন্থ থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা এর পার্থক্য বোঝাতে জীবনানন্দ দাশের ঝরা পালকের সঙ্গে তার ধূসর পা-ুলিপির তুলনা চলতে পারে। কারণ আবুল হোসেনকে যে নির্মেদ ভাষাভঙ্গির কবি বলে চিহ্নিত করা হয়তা মূলত এই কাব্যগ্রন্থ থেকে। এবং কথা সত্য আবুল হোসেনই প্রথম বাংলা কবিতাকে গদগদে আবেগ ভাষার ভাবালুতা থেকে মুক্তি দিলেন। তার মানে এই নয়, স্পর্শকাতর বিষয়গুলো তাকে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেয়নি। আসলে তিনি আকারে ইঙ্গিতে তার কষ্ট সংকল্পগুলো প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে একটি নাগরিক মন তাঁর কবিতায় প্রবলভাবে স্থান করে নিয়েছিল। আবুল হোসেনের ব্যথা বেদনা আবেগগুলো যে অব্যক্ত কান্না হয়ে প্রকাশিত হয় তার প্রমাণ-মাত্র দুসপ্তাহ বয়সী কন্যার মৃত্যুতে ব্যথিত আকুল পিতা লিখছেন আমার মেয়েকে শেরে বাংলার মৃত্যুতে, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে, কবি শাহাদাৎ হোসেনসহ অসংখ্য মৃত্যুতে ব্যথিত কবি লিখছেন কবিতা। এসবের মাধ্যমে কবির যে সংবেদনশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়-তা তার আবেগহীনতাকে সমর্থন করে না। প্রকৃতপক্ষে রগরগা আবেদনগুলো কবি তার তীক্ষè কাটাকাটা বাক্যের আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে পারেন।

No comments

FACEBOOK COMMENT