DEHLIJ

নাইম আহমেদ

নাইম আহমেদ এর কবিতা

নাইম আহমেদ





এক

একটা বিকট ঘোলা দুপুর জুড়ে পৃথিবী থমকে আছে আর আমি দূর্বার নিশ্চিন্ত ছুটে যাচ্ছি। আমার পায়ের নিচে পড়ে মুহূর্তে গলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে অলস ও বিভ্রান্ত যতসব স্থান, কাল, পাত্রের কনসোর্টিয়াম।

অথচ তোমরা ভাবছো ঠিক উল্টোটা। সরলীকরণ!
জীবন যদি এতই সরল হতো ডিয়ার সিস্টার, তাহলে তো আমরা একই সাথেই থাকতাম এখন, এতদিন পর।
অযথা পথ চলবার অনন্ত কাঠগড়া থেকে বলছি তবে: ধরে নাও এটা সত্য স্বীকারোক্তি, আত্মসমর্পণের পরে।

এই যে আমাদের আঙ্গুলে অন্যায্য জমে আছে আত্মগ্লানি, এক চোখে বিমূঢ় অভিমান আর অন্যটাতে দাবানল, এই যে আমরা অক্লান্ত বেঁচে থাকবার দায় থেকে অহেতুক ভালো থাকার, ভালো রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছি স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, একেই বলে আত্মপ্রবঞ্চনা। করবে, চলো?

কুয়াশাকে বিষন্ন আর শিশিরকে কোমল বলে বিশ্বাস করে এসেছো যারা, তাদের জন্য এই কবিতা লিখলাম।

শীত মূলত একটা বেগুনি মাফলারে জড়ানো সূর্যের অন্ধকার গ্রীবা, যে ঘেমে গিয়ে তুমুল বর্ষণ হয়েছিল।
যে তোমাদের উদ্ধত হৃদয়ে ঝরে গিয়ে ভেবেছিল, বেঁচে গেলাম এবারের মত হয়তোবা। এখানেই জীবন শেষ।

কিন্তু জীবন কি এতো সহজেই শেষ হয় ডিয়ার সিস্টার? তুমি আমাদের সেই কবিতা, যাকে লেখা যায়নি, যাবেনা কখনই। যে কেবল নিরন্তর মোচড় দিয়ে থেকে যাবে, ক্লান্ত বর্ষণমুখর ও কিছুটা অস্থায়ী বুকের ভিতর। অথচ তোমরা ভাবছো ঠিক উল্টোটা। সরলীকরণ !



দুই


প্রয়োজন ছিল না ঠিক! তবুও সময়কে ধরে রেখে ও অতিক্রান্ত করতে থাকার একটা ক্লিশে বিকেলে জানা গেলো, অনেক কিছু অধিকারে আনতে গিয়ে মানুষ মূলত, নিজের উপর থেকে অধিকার হারিয়ে ফেলেছে।

যে বিকেল কেবল কর্নার স্টোনের পাশে ঝুঁকে থাকা লেমন গ্রাসে লেপ্টে ঘুম ও ঘাম হয়ে যায়, সেখানে ক্রমশ স্থির ও অর্ধেক চলমান আলোকচিত্র হতে হতে কয়েকটি সিদ্ধান্তহীন চোখ, আলো আর অন্ধকারের মাঝামাঝি, এক ধূসর প্লাটফর্মের দিকে হেঁটে গেলো।

কথা হল: আমি তো সরব শবদেহ এক, উল্টানো। তবু ব্যবচ্ছেদ কেনো আমারই দায় হবে সবসময়?

সমাজ কি অস্বীকার করতে পারবে কখনও? প্রেম ও প্রত্যাখ্যান যখন সমান্তরাল ফিরে আসে অবনতে ঠোঁটে, রজনীগন্ধা হয়ে যায় ঘুমঘুম শিউলীর ফুল?
রাষ্ট্র কি পারবে দায় এড়াতে? এই যে কবিদের মরে গিয়ে মনে করিয়ে দিতে হয়েছিলো: তারা কবিতা লিখতেন! আঙ্গুল পুড়ে আঁকতেন পরিযায়ী মুখোশ!

সময়ের অপ্রয়োজনে কবিতা নিছক কোলাহল হলে, জেনে রেখো তুমি, কোলাহল নীরবতারই অংশ বিশেষ।
মুখোশ মুখে দেখি। প্রয়োজন ছিল না ঠিক, অধিকার? ব্যবচ্ছেদ কেনো দায় হয়েছিল কবিতা এবং যোদ্ধার?
 

তিন

চাইলেই তো বুক খুলে রোদ পোহাতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ সবকটি হৃদয়, যেকোনো খড়দুপুরে কফিশপে বসে!

তোমার শহরে ঘুরে মরি তোমারে ছাড়ায়। তুমি এক বিবাগী 'আমেরিকানো' হয়ে পাড়ি দিছো সারা শহর। কই কই যে যাই, গেছি, যাবো তারপরও। জানতা যদি কোনো একদিন। জানবা কি আসলেও, কোনো দিন?

কি যে চরম রোদ ওঠে বিকালে আজকাল, ঘোলাটে মেঘে জবুথবু ভিজে যায় সারাক্ষণ, লাবণী পয়েন্ট।
মানুষ হাসে। হোহো দাত বের করে হুহু করা কান্না লুকায়ে ফেলে বেমালুম। তুমি এসব, কিছুই বুঝোনা।

হৃদয়ের মধ্যে তুমুল জড়ায়ে ধরে আসো, খনন করি। একে অপরের মাঝে খুঁজে দেখেছি যেমন, কেউ নেই।

কেনো প্রতি বৃহঃস্পতিবার আমাদের মরে যেতে হয়? কেনো বৃহস্পতিবার আসে? না আসলেও কি হতো?

যেমন সবাই মিলে সেবার অনর্থক হেঁটেছিলাম কোনো গন্তব্য ছাড়া সারা সপ্তাহজুড়ে, শহরের নিরলস উপকূল। তারপর পেয়েছিলাম টের। সাতদিনে শেষ হয় না কখনো, আধুনিক সময় ভ্রমণ।

তাই মহীনের ঘোড়াগুলি আসে ফিরে প্রতি রাতে, কিন্তু ততক্ষণে বন্ধ হয়েছে অনন্ত কিছুক্ষণের জন্য, এক ঘেঁয়ে ক্লান্ত আর্তনাদের কফি মেশিন। বারিস্তারা খুলে রেখে চোখ থেকে হাসি, চলে গেছে বহুদূর।তাছাড়া বিষণ্ণ ঘাসের বদলে সেখানে কেবল কথা বলা কাঠ ও পাথর। তাই ঘুম ঢুলু ঢুলু চলে যায় ওরা, ক্যাফেইনহীন। কোথায় যেন বাজে নিঃশব্দ এক সুর:

"তাকে, যত তাড়াই দূরে দূরে,
তবু সে আসে মেঘলা চোখে ঘুরে ফিরে।"

চাইলেই বুক খুলে কুয়াশা উড়াতে পারতে তুমিও, উত্তর ক্লান্ত যেকোনো রাত দুপুর, বিনিদ্র কফিশপে !

আসলে কবিতা বলে যাদেরকে তোমরা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলে অনেকখানি, তারা সবাই মূলত দ্বিতীয় মুখোশ, মানে মুখোশের পিছনের মুখসমগ্র।

নিজেকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে বিপরীতে, নিজেদের আরো কাছে এসেছি ক্রমশ। আমার আর কোথাও যাওয়ার ছিল না, তোমারও?

তাই অবশেষে তোমরাই, কবিতা লেখার অপরাধে আমাকে শরীর আর শহরের মাঝে যেকোনো একটি বেছে নিতে বলা হয়েছিল। আমি কাঁচের চিবুক থেকে কোলাহল সেচে তুলে নিলাম 'এইট ডেইজ এ উইক'।

 
চার

যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই শেষ করা যাক। যা বলছিলাম। লাভ ইজ নট ম্যান্ডেটরি, অ্যাটঅল। ঠিক সেই মুহূর্তে তুমি। আমার মুমূর্ষ বৃহস্পতিবারে।

আমাকে রেখেই, আমাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। যেহেতু সেবার অনেক বর্ষা ছিল। ঘুম জানালায় বৃষ্টি। বৃষ্টি নয়। হৃদয়ের মতো ভারী পারদে দেবে যাওয়া এক একজন আত্মঘাতী স্মৃতি বোধ হয়? হাতে নিলে দেখা যায়, ছুঁতে গেলে ক্লান্তি লাগে সবকটি আঙ্গুল।

নিজেদের কণ্ঠের সরু রাস্তা ধরে এগোলেই নাগাল পাবো ভেবেছিলাম হৃদয়ের ক্লান্ত উৎসব উপকূল। অথচ ক্রমশ হারিয়ে গেছি কণ্ঠ থেকে কোথায় যেন।

সিলিংয়ে ঝুলে আছে টিয়ার শেলে ফেটে যাওয়া আকাশ, গোধূলি ও যাবজ্জীবন হুলিয়া নিয়ে কেউ।
যেভাবে আমি সাড়ে সাত দিন বেঁচে থাকি তোমার জন্য। আর আধা বেলা মরে যায় প্রত্যেক বৃহস্পতিবার।

জীবনের তথাকথিত স্নিগ্ধ গানের লিরিকস ঠোটে, মৃতদের বুকে আঙ্গুল রাখলে আলতো, জানতে তুমি।
সেখানে কেবল তোমার চুলের ঘামের মত সুগন্ধরা। প্রজাপতি হয়ে উড়ছে অদ্ভুত মুখের দিকে, কেউ।
জানতে চাচ্ছে, দিনশেষে কেনো ঘরে ফিরতেই হয়? কেনো লাইফ ইজ আল্টিমেট? ডেথ ইজ বিউটিফুল?

 
পাঁচ

ভেঙে পড়ছে সব। এর মধ্যে আমরা অসংখ্য ছেড়া পাল বুকে ছুটে চলছি। ভেঙে যাচ্ছে সময়। ফালি কুমড়ো একটা দুপুর বেলার। অবাধ্য প্লাটিলেট যেন।

আমার রক্তের সমস্ত ইটভাটা হয়ে গেল নীল জারুল। গলার ভিতর গর্জনের স্লিপার - কলিজা থেকে অক্সিজেন বয়ে আনছে তন্দ্রার মেল ট্রেন। বৃষ্টি নামছে নীল রঙ গলে। সূয়ারেজের পালতোলা অন্ধকারে আটকে আসছে শহরের চোখ। ভেঙে পড়ছে সূর্য। সাদা রঙের খই যেন এক ঝুড়ি। সমস্ত শহর জুড়ে দুর্বার কালো একটা এ্যাম্বুলেন্স ছুটে গেল। আর সব জারুল ফুল হয়ে ঢুলছে নীল ব্রোমাজিপাম।

তোমার ভয় নেই কবিতা। তোমার জন্য পৃথিবীর সর্বশেষ ব্লাড ব্যাংক রেখে যাচ্ছি। তুমি ভাঙবে না। ডুববে না। গলবে না। অথবা তোমাকে গুড়ো করে ছড়িয়ে দিয়েছি বলে পথ এত মজবুত। টলমল হাতির ঝিল, তোমাকে ডুবিয়েছি বলে স্বপ্নগুলো এমনই ভঙ্গুর। উড়িয়েছি বলে বাতাসে কেবল মাস্তুলের লবণ দোঁহায়।

অথবা তোমাকে পুড়তে হবে পেট্রোলিয়াম। বলতে হবে মুঠোফোনেঃ ভাল আছি। উড়ে উড়ে ঢাকতে হবে মুখ- আঁচল- ফ্লাইওভারের ফ্লোরোসেন্ট ডানা।

তোমার ভ্রূণ। আমার বীর্য। আমাদের সন্তান। শরীর শুষে বেঁচে থাকা?

হঠাৎ কবির চুল, পশম দুর্দান্ত পালক হয়ে গেল। আর কবিতা ভেঙে পড়ল একটা কিশোরী মুনমেন্টের মত। যেন আকাঙ্খার খাদ জুড়ে গড়ে উঠছিল জীবন।

No comments

FACEBOOK COMMENT