কুমার সুমন
রিষিণ পরিমলের কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার : মানুষের উৎস সন্ধান
কুমার সুমন
বাংলা কবিতার উত্তুঙ্গ মুহূর্ত বিশ শতকের নব্বইয়ের দশক। স্ব-মহিমা ও স্ববৈশিষ্ট্যে এ সময়ের কবি ও কবিতার প্রোজ্জ্বল উপস্থিতি। অবয়ব ও প্রকরণে নিরীক্ষা, বিষয় ভাবনায় আত্মোপলব্ধি, দর্শন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, মিথ, নৃ-তত্ত্ব, জ্যামিতি, নিসর্গ, প্রেম, দৈশিক-বৈশ্বিক চেতনা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার এ সময়ের কবিতার মূলে দ্যোতিত। এ সময়ের কবিতা ও কবি সত্তার মৌল পরিচয় যথার্থ ভাবেই চিহ্নিত ও উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা গবেষক ও অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান। তাঁর মতে, ‘নব্বইয়ের দশকের নবোদ্ভূত কবিদের একটা বড় অংশ আত্মনিমজ্জন ও অনুভূমিক মানস সম্প্রসারণের ক্ষেত্র হিসেবে, প্রত্ন-ইতিহাস, লোক-ঐতিহ্যের আদিভূমি, দেশি-বিদেশী কাব্যকলার চরিত্র, নিসর্গলোকের নবচারিত্র্য, জন্মসূত্রের সন্ধানে মাতৃজরায়নের অন্ধকারলোক সন্ধান, মরমীয়া শিল্প-ঐতিহ্যে অবগাহন প্রভৃতিকে কাব্যোপকরণের মূল উৎস হিসেবে গ্রহণ করলেন।’
রিষিণ পরিমল (জ. ১৯৬৬) নব্বই দশকের অন্যতম প্রতিভাবান অথচ প্রচার বিমুখ ও প্রতিশ্রুতিশীল কবি। স্কুলজীবনেই বিভিন্ন ‘বিশেষ দিবসে’র সাহিত্য-সাময়িকীতে কবিতা প্রকাশের মাধ্যমেই তাঁর কাব্যচর্চার শুরু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে কবিতা-সংগঠন ‘শব্দায়ন’ও লিটল ম্যাগাজিন ‘দ্রষ্টব্যে’র সংস্পর্শে তাঁর সাহিত্যিক স্ফুরণ ভিন্নমাত্রা পায়। লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্পধারায় কাব্যচর্চাকারী এই কবি আশির দশকের শেষ থেকে পুরো নব্বই দশক বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে (যেমন: কৃশানু, শব্দায়ন, কালপত্র, চালচিত্র, প্রমা, উত্তরণ, প্রয়াসী, লোক, দ্রষ্টব্য প্রভৃতি) ‘পরিমল রায়’ নামে লিখেছেন। প্রথম কাব্য ‘অন্তঃস্রোতের মানসাঙ্ক’ (২০০০) প্রকাশকালে তিনি নতুন নামের অধিকারী হন। ২০০০ সালের পরেও দুই বাংলার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে (যেমন: প্রতিশিল্প, চিহ্ন, ক্রম, কহন, লোক, দুন্দুভি, শাশ্বতিক, অক্ষর, বিভাস, ক্যাথারসিস, করুল, কারুভাষ, হাওয়া ৪৯ প্রভৃতি) তাঁর কবিতা চর্চা অব্যাহত রয়েছে। কবি হিসেবে তাঁর আত্ম-প্রকাশ, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা নব্বইয়ের দশকেই। তাঁর নিভৃতচারী কবি মানসে প্রোথিত মানবিক-রাজনৈতিক বোধ, প্রজ্ঞা আর বিরুদ্ধ স্রোতে অবারিত অবগাহন। এমন শুভ্র আকাঙ্ক্ষা ও দায়বোধের অনিবার্য তাড়নায় তিনি সময়ের সঙ্গে এগিয়ে লেখেন শুদ্ধ কবিতা। এই সরল ভাবনা কবির আত্ম-কথনে স্পষ্ট— ‘ভোরবেলাকার অন্ধকারে ভোরের আলো খুঁজি/জীবন সমেত ভাসছি কীরূপ বিরূপ বৈরী স্রোতে’। আবার কবি রিষিণ পরিমল তাঁর কবিতা ও কবি সত্তাকে একাকার করে হাস্যরসে উপস্থাপন করেন আপন অবয়ব। আর নক্ষত্র যেন তার আলো দিয়ে আলো জ্বেলে তাঁকে আলোকিত ও আলোড়িত করে কবিসত্তার বিকাশ ঘটায়। কবির কথনে— ‘ফিরে আসে ক্লান্ত যুবক, ফিরে কালো কবি/নক্ষত্র জ্বেলে দেয় তার পথে পথে রুপোর পঙক্তিগুলি।’
অসময়ে অথবা অনুপম সময়ে নৌকা বেয়ে বেয়ে রূপ-রস-গন্ধে-বর্ণে-পাখা মেলে কবিতার শরীর সাজান কবি রিষিণ পরিমল। তাঁর এই নির্মল কবিসত্তা ও কবিতা সম্পর্কে কবি ও গবেষক তপন বাগচীর নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ— ‘প্রচলের বিরুদ্ধে কথিত বিদ্রোহী না হয়েও যে নতুন কবিতা লেখা যায়, নিজের মনের কথা বলা যায়, রিষিণের কবিতা তারই প্রামাণিক দলিল।’
কবি রিষিণ পরিমলের প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ চারটি, ‘অন্তঃস্রোতের মানসাঙ্ক’ (২০০০), ‘নদী জলে চৈত্রদাহ’ (২০০২), ‘শীতের অরণ্য জানে ফাল্গুন কতদূর’ (২০০৭), ‘জীবন সর্বদা উত্তম পুরুষ’ (২০১৮)। কবির এ চারটি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো নব্বইয়ের দশক ও বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে রচিত হলেও ভাবকেন্দ্রের দিক থেকে কাব্যগুলোর ঐক্যসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিটি কাব্যের মূলসুরে নিসর্গ, প্রেম, স্মৃতিসত্তা, ইতিহাস চেতনার সাথে সময় চেতনা, প্রত্ন-ইতিহাসের মধ্যে শিকড়ের সন্ধান অর্থাৎ মানুষের উৎস সন্ধান, ইতিহাস-উত্তরাধিকারের উপাদান প্রভৃতি প্রসঙ্গ কালের চেতনাতলকে স্পর্শ করেই অভিব্যঞ্জিত। এছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দৈশিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির রূপবৈচিত্র্য এবং সমকালীন ব্যক্তিক-সামাজিক অসঙ্গতি ও অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কনের প্রয়াস তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায়। কবির কাব্য-ভাবনায় উৎসারিত ইতিহাস ও সময় চেতনা, ঐতিহ্য-উত্তরাধিকারের উপাদান এবং মানুষের উৎস-সন্ধান প্রভৃতি বিষয় এ আলোচনায় বিবেচ্য।
২.
ইতিহাস ও সময় যেন চিরায়ত সহোদর। সময়ের বাঁক পর্বের নানা অনুঘটন-ঘটন প্রবাহই হয়ে ওঠে কালানুক্রমিক ইতিহাস। উভয়ের এই সম্পর্ক-রেখায় কখনো সময় ইতিহাসকে প্রভাবিত করে আবার কখনো ইতিহাস সময়কে চালিত করে। গতিমান সময়ের এই চলন-বলন, গমনাগমন ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্রিয়াশীল অবয়বে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে শিল্প-সাহিত্য। নানা মাত্রিক ভাব-ব্যঞ্জনায় ইতিহাস ও সময়ের তাতে উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিশেষত কবিতার শব্দ-শিল্প-ভাষ্যে ইতিহাস ও সময় কাব্যিক ভাবাবেশে উদ্ভাসিত হয়। কবিগণ ইতিহাস ও সময়ের সম্মিলনে কবিতার শরীর সাজান। তাতে করে কবিতা হয়ে ওঠে ইতিহাস ও সময়ের প্রামাণিক দলিল।
কাব্যকলার নানা পর্বে কবিগণ ইতিহাস ও সময়কে ধারণ করে কবিতা-শিল্প বিনির্মাণ করেছেন। নব্বইয়ের দশকে এই ভাবনা বিনির্মাণের অন্যতম কারিগর রিষিণ পরিমল। তিনি ইতিহাস ও সময়কে শুধু জানিয়ে দেন না, বরং তার অভ্যন্তরে প্রজ্ঞার সঞ্চারণ ঘটান। ফলে সে ইতিহাস পঠন-পাঠন কিংবা ঐতিহাসিক বর্ণনে বাক্স-বন্দি না-হয়ে চিন্তন-দর্শনের মহাকালিক রূপাবয়ব ধারণ করে। এ প্রসঙ্গে কবি উত্তম দাশের মন্তব্য— ‘রিষিণ পরিমলের কবিতায় আছে ইতিহাস চেতনার সাথে সময় চেতনা। প্রত্ন ইতিহাসের মধ্যে তার শিকড়ের সন্ধান। অর্থাৎ মানুষের উৎস সন্ধান।’ ‘অন্তঃস্রোতের মানসাঙ্ক’ কাব্যের “যাত্রা” কবিতায় কবি দীঘল মাঠের, সীমাহীন, দুঃসহ রাতের চিত্রল বর্ণনা আর মৃত নদী ও পোড়ানো পাহাড়ের প্রতীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশস্ত ইতিহাস, আত্মত্যাগ, ধ্বংসযজ্ঞ ও পঁচিশে মার্চের মধ্যরাতের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাসকে ইঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন—
মাঠের পর মাঠ অবিভাজ্য রাত
তারপর মরানদী তারও পরে পোড়ানো পাহাড়
মার্চের মধ্যরাত রক্তাক্ত শিমুলের তল
কাল পরিক্রমায় উদার মানবিক সভ্যতা ক্রমাগত যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। অথচ ইতিহাস বাস্তবতায় পূর্বে সমাজ-সভ্যতা অনেক মানবিক ছিল। কবি রিষিণ পরিমল অতীত ও চলমানের তুল্যমূল্যে যন্ত্র সভ্যতার প্রলেপে থাকা অমানবিক ও লুটেরাজ তথাকথিত স্বর্ণময় সময়ের চেয়ে সরল, মানবিক ও উদারনৈতিক পুরনো ঐতিহ্যকে পুনরায় স্মরণ করেছেন এবং খেদোক্তির প্রোজ্জ্বল ব্যঞ্জনায় কবিতা-শিল্প-ভাষ্যে তা চিত্রায়ণ করেছেন। তাঁর “পুনশ্চ” কবিতায় এর প্রমাণ মেলে—
মতিঝিলে দাঁড়ানো বাস
বাসের গ্লাসে দশতলা দস্যু দালান
এর চেয়ে গভীর উদার ছিলো ঘোড়াগাড়ির ঢাকেশ্বরী।
আবহমান বাংলা নানা সময়ে বিপন্নতায় পর্যবেশিত হয়েছে। ইতিহাস পরম্পরায় এমনই একটি সময় ২০০২ সাল। এ সময়ে সারা দেশব্যাপি নৈরাজ্যের কালো ছায়া নেমে এসেছিল। ফলে চিরায়ত বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়েছে। সোনার বাংলার এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কবিমন বেদনাহত, হতভম্ভ। তাই “হা হতোস্মি : ২০০২” কবিতায় তিনি বলেন—
এসো হে বৈশাখ : বিপজ্জনক চারপাশ
মাছ ভাতে বাঙালি : বিপজ্জনক চারপাশ
সোনার বাংলা ভালবাসি : বিপজ্জনক চারপাশ
বাঙালি বাংলাদেশ : বিপজ্জনক চারপাশ
বৈশ্বিক দুর্বিত্তায়ন, মুনাফাখোরী মনোভাব, অনাচার, অসাধু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি, পোশাকি অবয়বের অন্তরালে যৌন-লিপ্সা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে। শুধু মুনাফাই মুখ্য— সময়ের এ প্রচলতা ও ঐতিহাসিক সত্যাসত্য “বৈশ্বিক জলবায়ু : বিশ্বময় দুর্বিনীত প্রাকার” কবিতায় ব্যঞ্জিত হয়েছে—
চারিদিকে বৈশ্বানর, যৌথ অনাচার
ফুটফুটে যৌনকলা বিভূতি শতেক;
রুপালি পোশাকে মোড়া রুপোহীন প্যাক
‘ব্যবসা’ ‘ব্যবসা’ করে চেঁচায় হকার।
কবি রিষিণ পরিমল দুঃসময়-অসময় প্রত্যক্ষ করেছেন। দিন শেষে ঘরে ফিরে তিনি রাতভর চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ ও হিসেব-নিকেশ করেন। শুভর সঞ্চয়ী প্রবৃত্তিতে ইতিহাস ও সময়ের নিরিখে এর কার্যকারণ আর মহিমা অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন তাঁর “দুঃসময়” কবিতায়। কবির ভাষায়—
ফিরে আসি
দিন শেষে ফিরে এসে সারারাত তুলোধুনো করি
উপায় হলো কিছু তুলো সঞ্চয়ের এই বর্ষায়
তুলোধুনো করি আর আদ্র বাতাসে রঙধনু খুঁজি
নিয়ত সময় ও ইতিহাসের পরম্পরার ভাঙনে পারিবারিক যূথবদ্ধতা ভেঙে যায়। এই ভঙ্গুরতা ও ভাঙনের ঢেউ ক্ষয়িষ্ণু স্রোতে সংক্রামক রোগের মতো ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। কবি এমন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ক্রুশবিদ্ধ হয়েও যৌথ-জীবনের জয়গান গেয়েছেন। বারবার সামাজিক-রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় চেতনার অসংগত ক্ষয়ের উন্মাদনায় আহত হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। “উজার” কবিতায় এ তথ্য বিধৃত—
ভাঙন ভাঙন ভাঙনের চণ্ডধ্বনি
প্রাণের পাঁজরের প্রাণিত বোধের পরে
ক্রুশ বিন্ধ করে, আহা ! অন্ধ অহঙ্কারে
ক্ষরণ-ক্ষঞ্জরে ক্ষত মাতা মাতৃভূমি
প্রতিদিন ভেঙে যায় যৌথ পরিবার
অসঙ্গত স্রোতে ক্ষয়ে যাচ্ছি রীতিমত
উন্মাদনায় বাড়ছে সংক্রামক ক্ষত
যূপকাঠে প্রণত হচ্ছি বারংবার
“উজানগীত” কবিতায় পুনরায় বিদ্ধ হয়ে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হবার কথা বলেছেন। এই রক্তাক্ত অবয়ব ব্যক্তিক নয়, সামষ্টিক। তবু স্বপ্নাতুর ও সুসময়ের আকাক্সিক্ষত কবি মানস শস্যরঙা তথা সমৃদ্ধির রঙিন ভাবনায় মগ্ন থাকেন। পৌরাণিক চাঁদ সওদাগরের নিঃস্ব অবস্থা পুনরুদ্ধারের মন্ত্র সাহসী পুত্রবধূ বেহুলার সংগ্রামের মাধ্যমে উদ্দীপ্ত করলেন। এ কবিতায় কবি যেন সমকালে ও অনাগতকালে প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি যোগালেন বেহুলার একক সাহসী মনোভাবের মাধ্যমে। কবির উচ্চারণ—
চাঁদ স’দাগর হলো সেই সে কবে
পুত্র ম’লো পুত্রবধু ভাসালো ভেলা
ভীষণ-উজান দূর্বিপাকে ভাসি একেলা
ধর্মীয়-রাজনৈতিক সর্বোপরি বৈশ্বিক চক্রান্তের বিষময় পরিণাম ১৯৪৭-এর দেশভাগ। যা মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করেছে, ধর্মের নামে মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করেছে, দেশান্তরি ও উদ্বাস্তু করেছে। ঐতিহাসিক এই বিশৃঙ্খল বিপর্যয়কে “হ য ব র ল” কবিতার শিল্পাবয়বে উপস্থাপন করলেন তিনি। কবির বেদনাহত ও বিস্মিত উচ্চারণ নিম্নরূপ—
দেশভাগ, হায় স্বাধীনতা
বিষবৃক্ষে বিষম বিফল
দেশান্তরে মানুষ বদল
ধর্ম কাটে ভূমি, বিপন্নতা !
কবিতায় জ্ঞান-প্রজ্ঞা আর কর্মযজ্ঞের নির্মোহতায় সসীম সময়ে অসীম অমরত্ব লাভের কথা বলেন কবি রিষিণ পরিমল। যা নিখুঁত বোধের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে নিমেষেই ইতিহাসের অংশীদার হয়ে যায়। “সময়” কবিতায়—
সময় অখণ্ড তার অবিরাম গতি
দূর তার চারিধার অপরূপ ধূসর
সময়ে সীমিত তবু মানুষ অমর
খণ্ডেই নিখুঁত আঁকে আপন প্রতীতি
অতিক্রান্ত জীবনের যাপন প্রক্রিয়ায় কবি রিষিণ পরিমল কাব্যিক দ্যোতনায় দেখান কীভাবে সময়ের সাথে সময়ের বদল ঘটে। প্রাত্যহিক জীবনাভিজ্ঞায় তিনি দিগন্তের সীমানা পরিবর্তনের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন “দিনযাপন” কবিতায়—
দিন যায়
দিন বদলের দিন
ভূঁইচাপা ভ্রুণ
মাথা তোলে—
দিক বিদিকে তাকায়, দিন যায় ...
দিগন্তে দিনের সীমানা বদলায়
৩.
ইতিহাস-ঐতিহ্যের পথ ধরে নির্মিত হয় নয়া ইতিহাস-ঐতিহ্য। সে ইতিহাস অতীত বর্তমান ও অনাগতকালের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করে। সভ্যতা বিগত ইতিহাসের শেকড় থেকে পরিভ্রমণ করে পরবর্তী প্রজন্মের পরম্পরার অংশ হয়ে ওঠে। সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক সূত্র অভিন্ন রূপ ধারণ করে ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। ইতিহাস-উত্তরাধিকারের এই সমান্তরাল চেতনা প্রবাহ কবিতার শিল্পেও বহুভাবে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে। বাংলা কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইতিহাস-উত্তরাধিকার ভাবনা। এই চেতনা বহুমাত্রিক ভাবাবেশে আধুনিক বাংলা কবিতায় দ্যোতিত হয়েছে।
নব্বই দশকের অন্যতম ও বিকল্পধারার কাব্য চর্চাকারী কবি রিষিণ পরিমলের কবিতা-পরিম-লের অনন্য অনুসঙ্গ ইতিহাস-উত্তরাধিকারের উপাদান। তাঁর কবিতায় প্রচল ইতিহাসের বর্ণনা নেই আছে বাঁক বদলের কথা— তা প্রাচীনতার শেকড়ে প্রোথিত। মিহি আলো, পুরাতন ও জীর্ণতার অবয়ব সরে ক্রমে নতুন আলোক রশ্মির সহযোগে প্রোজ্জ্বল আলোর ভুবনের দিকে পৌঁছেছে। “আলোকবৃক্ষ” কবিতায় পাই—
আলোকবৃক্ষ গেড়েছে শেকড়—
ভাঙা দরোজা, ঘুণোচৌকাঠ, ভুতুড়ে আসবাব
মিহি আলোময় আলোকময়।
বিগত ইতিহাসের তিক্ত ও ভগ্ন স্বপ্নের পরিণাম কী তা কবি তাঁর সময়ের মানুষজনকে স্মরণ করিয়ে দেন। স্বপ্ন ভাঙার পরিণাম কত ভয়াবহ তা বলতে ভোলেননি কবি। যদিও মানুষ সে ইতিহাস ভুল মানুষের বলে মনে করে আড়াল করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ ভুলের কারণে সরল জীবনে সংকট নেমে আসে। তাই কবি বিশালাক্ষী নদীর পাারে দাঁড়িয়ে যেন স্পষ্টতই মানুষকে জানিয়ে দেন পরিণতি। “বিশালাক্ষী পারে” কবিতায়—
নক্ষত্র মানব, স্বপ্ন ভেঙে গেলে
পৃথিবীর কুলভেদ ভুলে অশোকের
স্বচ্ছ জলে নেমে আসে—
নিম নিম স্বাদ নিয়ে কতোকাল আগে
তারা পৃথিবীরে ভুলেছিল, মৃতমন মানুষের
কথা ভেবে, জ্যোস্নার কথা ভেবে—
বহুকাল আগে তারা শীতনিদ্রার দেশ ভুলেছিলো।
“আমৃত্যু যৌবন গান” কবিতায় কবি প্রাচ্য পুরাণের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। ‘মহাভারতে’র অসম সাহসী বীর অঙ্গরাজ কর্ণের উত্তরসূরী ও ভ্রাতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। কর্ণের মাধ্যমে মূলত কবি জীবন সংগ্রামে নিবেদিত নির্ভীক দেশপ্রেমিক মানুষের কথা বলেছেন। পুরাণেতিহাসের এই বীরযোদ্ধার রক্ত ও চেতনা যে আমাদের শেকড়ে প্রোথিত তিনি সে কথা যেমন কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন তেমনই কর্ণের মাতৃভক্তির সাথে সাহসী বাঙালি যুবার দেশ-মাতৃকা প্রেমের তুলনা করেছেন। যেমন—
আমারও শব্দ আছে ধনুকে ও তূণে অযুত অগ্নিবাণ
কর্ণের দোসর আমি অথবা সোদর
মাত, অনলে প্রোথিত শিকড় আমার, সত্তায় যৌবনগান
ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যে বিভাজন ও ভাগাভাগি দেশ-বিভাগের মধ্য দিয়ে করা হয়েছিল রাষ্ট্রের বিভাজন নয় প্রকারান্তরে মানুষের বিভাজন। ঐতিহাসিক এই ভুল কেবল রাষ্ট্রকে নয় পারিবারিক ও ব্যক্তিক জীবনকে বিভক্ত করেছে। স্বার্থবাদী এই মনোবৈকল্য শুধু ইতিহাসকে নয়, উন্নত সভ্যতাকে খণ্ডিত করেছে। কবি মানুষের এই স্বার্থানেষী কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হয়েছেন। “বিভাজন” কবিতায়—
হায়, অতীব উন্নত সভ্যতা
সীমান্ত-পথরেখা ধরে এ কেমন মস্তক খণ্ডন !
এ কবিতায় সীমান্ত, কাঁটাতারের অনুষঙ্গে মানুষের মনুষ্যত্বহীনতা, ভূখণ্ড তথা পৃথিবীকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠি স্বার্থে খণ্ডিত করার এমন রূঢ় বাস্তবতা ও দায়িত্বহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় সভ্যতাকে প্রশ্নবাণ ছুঁড়েছেন। কবির ভাষায়—
হায় সীমান্ত হায় কাঁটাতার
মানুষেরা দূরে যায় ক্রমশ মানুষ হতে,
পৃথিবী খণ্ডিত, ন্যূব্জ ব্যক্তিতান্ত্রিকতায়।
সভ্যতার প্রখর শিকড়ে বাড়ে এ কোন্ দায়ভার?
মানব সভ্যতার বেড়ে ওঠার অন্যতম সহায়ক হচ্ছে নদী। নদীকেন্দ্রিক জীবন প্রণালী ছিল আদিম মানুষের প্রধান অবলম্বন। নদীর এই পাড় ভাঙা আর গড়ার ইতিহাস মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাস। নগরের ভাঙা-গড়া তো বহমান জীবনেরই প্রতিকৃতি। লোকজ পুরাণ ও গতিশীল জীবনের অনিন্দ্য উত্তরাধিকারকে কবি রিষিণ পরিমল তাঁর “নিদ্রা” কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন। কবির ভাবনায় ক্রিয়াশীল নদী, ঋতুচক্র, নগর, স্বপ্ন ও লৌকিক উপাদান জনবোধের দ্যোতক। একই সাথে তা ইতিহাস ও উত্তরাধিকারেরও বাহক। কবির শব্দ যোজনায়—
দিনে দিনে ঋতুচক্র বাড়ে অন্ধকার
ঘুমের ভেতর স্বপ্নে জেগে ওঠো আর
নগর গড়ে নগর ভাঙো পারে
ঘুমাও স্বদেশ শঙ্খমালা জাগিও না আর
“বিপন্ন বাগদাদ” কবিতায় কবি মার্কিন পুঁজিবাদে রোষানলে দগ্ধ, ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত ও বীভৎস বাগদাদের ধ্বংস চিত্র রূপায়িত করেছেন। মার্কিন পুঁজিবাদের কালো থাবায় বাগদাদ ও তার সমৃদ্ধ নগর ইতিহাস যেন লুপ্ত প্রায় এবং নিজ দেশেও শৃঙ্খলিত, গৃহহীন, উদ্বাস্তু, পরবাসী। কবি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই উদ্ধত আচরণকে আমলে না নিয়ে যেন অসহায় বাগদাদিতের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। বাগদাদের এই বিপন্নতা কাব্য দ্যোতনায় ব্যঞ্জিত—
দ্রুম দ্রুম দ্রিম দ্রিম
বোমাহত বাগদাদ
শৃঙ্খলিত তুমি, তোমার জন্মভূমি
আকস্মাৎ গৃহহীন তোমার স্বজন
দিশেহারা তারা মরু মধ্যে হারিয়েছে পথ
ধ্রুপদ নগরী অন্ধকার, উদ্ধত মার্কিন পুঁজির প্রমাদ
মার্কিনীর এই কালো থাবা থেকে বাগদাদের প্রজন্মও যে নিরাপদ নয় সেটাও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। বরং তার উত্তরাধিকারের সংসারও যেন বিপন্ন এই সংঘাতের ঘাতে-প্রতিঘাতে। কবির কাব্য ভাষে—
মাতা-মাতামহীর ওষ্ঠাগত প্রাণ
ধূলিঝড় অগ্নিঝড়
আর প্রখর সংঘাতে বিপন্ন সংসার
উত্তরাধিকার
বাংলার ইতিহাস রক্তস্নাত ইতিহাস। রক্তের এ স্রোত যেন হাজার বছর ধরে প্রবাহিত। ইতিহাসের নানাপর্বে আমাদের প্রিয় জননী জন্মভূমিকে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত করা হয়েছে। বর্গী বেনিয়া থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বারবার আমাদের স্বদেশভূমিকে রক্তাক্ত করেছে, বাঙালির সাজানো সংসার তথা স্বদেশ বিক্ষত করেছে। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। যা শুধু ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ব্যাপার নয়, বরং উত্তরাধিকারেরও পরম অহংকারের বিষয়। কবি তাই আবেগে ও অহংকারে উচ্চকিত কণ্ঠে “বাংলাদেশ” নামক কবিতায় বলেন—
রক্তস্নাত বাংলাদেশ জন্মভূমি জননী আমার
অভিনব মাতৃত্বে সাজানো তার পাতার সংসার
ভেঙে দেয় বারবার বর্গী বেনিয়া পশ্চিমা হানাদার
রক্তাক্ত স্বদেশ আবার দাঁড়ায়, আমাদের অহংকার
এ কবিতায় ইতিহাস ও উত্তরাধিকারের প্রোথিত উপাদানের হাজার বছরের আবহমান বাংলার ঋদ্ধ ইতিহাস, আলোকিত জীবন প্রবাহ, সুখময় সম্প্রতি ও প্রতাশ্যা কবির মানস চেতনায় আন্দোলিত হয়েছে। কবির ভাষায়—
এদেশ স্বদেশ শুধু নয়, ভাষা নয় শুধু ভাষা
এ মৃত্তিকা স্নেহময়ী মাতা, তার অন্তঃক্ষরা বাণী
হাজার যুগের জীবন প্রবাহে প্রাণের সিম্ফনি
শত শতাব্দীর ঋদ্ধ ইতিহাস, সম্প্রীতি, প্রত্যাশা
৪.
সভ্যতার ইতিহাস মূলত মানুষেরই ইতিহাস। মানুষের উৎস সন্ধানই ইতিহাসের মূলকথা। মানুষকে বাদ দিয়ে মানব-সভ্যতা কল্পনাতীত। নৃবিজ্ঞান মানুষের উৎস অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকারান্তরে প্রত্ন-ইতিহাস উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছে। মানুষের উৎস নিয়ে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞানে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা আছে। আধুনিককালের কবিগণ কবিতা-শিল্পের অনুষঙ্গে প্রত্ন-ইতিহাসের সাথে মানুষের উৎস সন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন। ফলে মানুষ ও তাঁর ইতিহাসও বাংলা কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। নব্বই দশকের অন্যতম শিকড় সন্ধানী কবি রিষিণ পরিমলের কাব্য ভাবনায় মানবেতিহাসের প্রত্ন-নিদর্শন রূপায়িত হয়েছে।
পৃথিবীতে মানুষের আগমন রহস্য উন্মোচন করেছেন কবি রিষিণ পরিমল। তিনি মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমনকে কবিতা-শিল্প ব্যঞ্জনায় খোলা রোদ, বর্ণিল আলো, বাতাস ও অসাধারণ নৃত্য কলার আবির্ভাব বলে মনে করেন। মানুষের উৎস অন্বেষণের কথা তিনি তাঁর “জন্ম” কবিতায় ব্যক্ত করলেন—
এই পথে রোদ আসে
খোলা রোদ
শতবর্ণ আলো ও বাতাস
এরও পরে চারুনৃত্যে আসে, প্রত্ন আলো
আদিম মানুষ
“উয়ারি-বটেশ্বর” কবিতায় অনুসন্ধিৎসু কবিমন প্রত্ন নিদর্শনের শেকড়, ব্যবহৃত অলঙ্কার, তৈজষপত্র, মৃৎপাত্র, মুদ্রা, অস্ত্রের অন্বেষণ করেছেন গর্ভবতী মাটি খননের মাধ্যমে। সভ্যতার এই প্রত্ন ইতিহাস মূলত মানুষেরই উৎস অনুসন্ধানের প্রয়াস। এখানে ‘মাতা’র প্রতীকে ‘মাটি’কে প্রতীকায়িত করে ভূগর্ভস্ত প্রত্ন-বস্তুর সাথে মাতৃগর্ভে স্থিত সন্তানের তুলনা করা হয়েছে। সন্তানের জন্মের ইতিহাস যেমন মাতার জ্ঞাত, সভ্যতার ইতিহাস তেমনি ‘মাতাসম মৃতিকা’র জ্ঞাত। একারণেই মাতাসম মাটি খননে মানুষেরই প্রত্ন-ইতিহাস বেড়িয়ে আসে। “খনন” কবিতায় এ সম্পর্কিত কবির প্রাজ্ঞ উচ্চারণ—
খনন খনন প্রতিদিন খননের কাজ
মাতাসম মৃত্তিকা মানুষেরে দেয় মানুষের প্রাচীনেতিহাস
আদিবাসী জীবনের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। তিনি আদিবাসী সাঁওতাল যুবতীর সংকট, টানাপোড়ন, দুঃসহ জীবন-যাপন, ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের অভ্যন্তরে আদিবাসী জনজীবনের অসহায়ত্বের চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই সাথে আছে মানুষের অমানবিক কর্মকাণ্ড যেখানে স্বপ্ন-প্রেম-মানবিকতা পরাজিত। অথচ প্রত্ন-ইতিহাস বলে এই জনগোষ্ঠী আমাদের আদি উদগাতা। আমরা যেন সে কথা ভুরে যেতে বসেছি। ভীমপুর গ্রাম, আদিবাসী জীবন, শিলা-পাথরের কথা স্মরণ করিয়ে আমাদের আদি জীবনাচরণকে প্রকাশ করেছেন। “অপরাহ্ণে শীতার্ত ভীমপুর” কবিতায়—
এই দেশ ভুলে গেছে এই নদী এ গাঁয়ের নাম
এই গ্রাম ভীমপুর, সা’তাল বসতি : শিলা পরিণাম
পারে শিলা পাড়ায় শিলা দৃশ্যান্তে শিলারণ্য
পাথরে পাথরে পালালো যুবতী, পাথুরে অপরাহ্ণ
মানবেতিহাসের শেকড় সন্ধান করতে গিয়ে কবি মানুষের অতীতকে পর্যালোচনায় এনেছেন। মানুষের অতীত খুব একটা সহজ, সুখকর ছিল না। ঘূণে জীর্ণ, দীর্ণ আর অন্ধকারের রেখাপাত তাতে ছিল যা স্বকালেও বিদ্যমান। সভ্যতার এই প্রত্ন-ইতিহাস যে সবার জানা সেটাও কবি বলে দেন স্পষ্ঠভাবে। “কবির প্রতিকৃতি” কবিতায় এ সত্য ব্যাঞ্জিত—
অথচ এ শহর জানে পূর্বাপর
সরল সুলভ নয় তোমার অতীত
নুলো আর ঘুণে জীর্ণ দীর্ণ কঙ্কালের ভীত
কাল ব্যেপে অন্ধকার একাঙ্গ জমজ সহোদর
মানুষের উৎস অনুসন্ধানের পাশাপাশি কবি মানুষের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, অবদানকে উচ্চকিত করেছেন। কেবল মানুষই মানুষের সহযোগী, বন্ধু ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের কলাকার এমন দৃঢ় ভাবনা তাঁর মর্মমূলে প্রোথিত। তাই “মানুষ” কবিতায় তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ—
মানুষের দানে হে ঋদ্ধ পৃথিবী
মানুষ কি বাঁচে বলো মানুষ বৈ
জীবন-সত্যকে উদ্ঘাটন করতে গিয়ে কবি জীবনকে খুব বিশাল-বিস্তৃত মনে করেননি। বরং বহমান জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ নানা উত্থান-পতন আর জল, বায়ু, রোদময়তাই জীবনকে মহৎ ও সর্বোত্তম পর্যায়ে নিয়ে যায় এমনটাই তাঁর বিশ্বাস। সে সত্যই কবি উচ্চারণ করলেন তাঁর “জীবন” কবিতায়—
তবু জীবন জয়ী হয়, উঁচু তারে বাঁধে স্বরগ্রাম
জীবন সর্বদা উত্তম পুরুষ, নয় সর্বনাম
নব্বই দশকের কবি রিষিণ পরিমলের কাব্যচর্চা এখনও চলমান। নিভৃতে থেকে তিনি কবিতা-শিল্প নির্মাণ ও প্রকরণ শৈলীর নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। উভয় ক্ষেত্রে তিনি সিদ্ধ হস্ত। সুরম্য শব্দ যোজনা, নিত্য নতুন শব্দ তৈরি, শোভন কোমলতা, সরল উপস্থাপন, বিষণ্ন আবেগ, আত্ম-জীবন দর্শন তাঁর কাব্য ভাব ও ভাষাকে ঋদ্ধ করেছে। তবে নব্বইয়ের দশকের কবিতা শিল্পের চেয়ে তাঁর চলমান সময়ের কবিতাগুলো ভাব-শব্দ-শিল্প ভাষ্য ও উপস্থাপন রীতিতে আরো বেশি প্রাঞ্জল, হৃদয়গ্রাহী ও ব্যঞ্জনাদীপ্ত। তাঁর কবিতার সরল অথচ অনন্য উপস্থাপন চিরায়ত কাব্যরসে উদ্ভাসিত যা পাঠক চিত্তে চিত্রল কাব্যানুভূতি ও রসাস্বাদ সঞ্চারিত করে। ফলে বলা যায়, উপস্থাপন কৌশলের কারণেই কবি রিষিণ পরিমল তাঁর সময়ের এবং চলমান সময়ের বড় কবি। হয়তো এমন উপলব্ধির বুদ বুদ থেকে কবি ও গবেষক তপন বাগচী কবি রিষিণ পরিমলের কবিতা সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন— ‘কেবল বলার ভঙ্গির কারণেই রিষিণ পরিমলের কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর সময়ের এবং তাঁর পরপ্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় সম্পদ।’
Post a Comment