DEHLIJ

সুব্রত কুমার দাস

ফিরে দেখা আমার রক্তাক্ত জন্মভূমি

সুব্রত কুমার দাস



আমি এখন কানাডার টরন্টো শহরে থাকি। এগারো হাজার কিলোমিটার দূরে একটা দেশ আছে। তার নাম বাংলাদেশ। সেখান থেকে কানাডায় এসেছিলাম দশ বছর আগে। কারণটা কী ছিল? 

আসলে মানুষ যখন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যান, তার পেছনে অনেক রকম কারণ থাকে। যেমন কারও কারও জন্য কারণ হয় পেশাগত উন্নতি, বড়ো চাকরি, উন্নত জীবন-যাপন, বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ, বেশি অর্থ উপার্জন ইত্যাদি। আবার কারও কারও জন্য এমনও হয় যে, নিজের দেশটি নিরাপত্তাহীন মনে হয়। সেই মনে হওয়ার কারণে তারা একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজতে শুরু করেন। কারও কারও নিরাপত্তাহীনতা ভয়ানকভাবে অল্প সময়েই ঘটে যায়, কারও কারও জন্যে সেটি হতে থাকে ধীরে ধীরে। আমার জন্য শেষোক্তটি কাজ করছিল। 

তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আমি কী করে হঠাৎ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বা পিআর হয়ে ভিসা নিয়ে চলে এলাম? মানে, আমি তো এসেছি যেটাকে বলে দরখাস্ত করে, পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হয়ে। এখানে বিষয়টা কী হয়েছিল বলি। সেই সময়টাতেই – তিন-চার বছর ধরে – আমি আসলে একটু একটু ভাবতে শুরু করেছিলাম অন্য কোনো উন্নত দেশে চলে আসার – কারণ একটা অস্বস্তি, একটা অশান্তি কাজ করতে শুরু করেছিল। তেমন একটি সময়ে আমি আবেদন করি কানাডায় ইমিগ্রেশন পাবার জন্যে। সেটা ছিল স্কিলড ক্যাটাগরিতে। আবেদনটা করে ফেলেছিলাম নিজে নিজেই – হেলাফেলাভাবেই। তারপর যখন নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটি ২০১৩ সালে – বাংলাদেশের একটি বিশেষ সময়ে – খুব বেশি তীব্র হয়ে উঠেছিল, আমার কপাল এমনই যে, ঠিক সেই সময় কানাডা ইমিগ্রেশনের পক্ষ থেকে আমার চিঠির চূড়ান্ত উত্তর এলো এবং আমাকে মেডিক্যাল করতে বলা হলো। এরপর ভিসা পেয়েই আমি চলে এলাম। 

পাঠক বুঝতে পারছেন আমি আসলে ধর্মীয় নিরাপত্তার ইঙ্গিত করছি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অথবা যদি বলি হিন্দুদের অথবা যদি বলি হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের এই যে নিরাপত্তাগত অবস্থা সেটি তো সবাই বাইরে থেকে অনুভব করতে পারেন না। যেহেতেু আমি জীবনের ঊনপঞ্চাশ বছর দেশে থেকেছি, আমি নিজে যেহেতু অমুসলিম, এই জিনিসটি দীর্ঘদিন ধরে দেখেছি। এখন কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি বলবো যে, সেটি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই শুরু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল এরকমভাবে যে, তাঁকে হত্যার ভেতর দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা, সেটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং সেই চেতনা যদি ধ্বংস হয় তাহলে এর যে বিপ্রতীপ চেতনা – যেটি হলো একটি মৌলবাদী চেতনা, পাকিস্তানি চিন্তার চেতনা – সেই চেতনার বিকাশ হতে শুরু করলো এবং সেই বিকাশ ক্রমে ক্রমে সমাজের সর্বত্র প্রবাহিত হতে শুরু করলো। তার ভয়ঙ্কর প্রভাব আমরা দেখেছি সারা দেশজুড়ে। 

স্বীকার করতে হবেই যে, তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। সে কারণে কিন্তু প্রভাবটি সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং আমরা দেখতে পেলাম যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই মানুষেরা, যেই শক্তি স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি ছিল, যারা ছিল আলবদর, রাজাকার, যারা ছিল পাকিস্তানের দোসর, যারা বাঙালি চেতনার বিরোধী শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছিল এবং পাকিস্তানের পদলেহন করেছে ১৯৭১ সালে – সেই মানুষেরা, সেই গোষ্ঠী এই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর ক্রমে ক্রমে মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকলো এবং তারা রীতিমতো রাষ্ট্রকে করায়ত্ত করে ফেলতে শুরু করলো। আমরা দেখলাম যে, যারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে, লুকিয়ে থেকেছে, গা আড়াল করেছে, তারা এসে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে শুরু করলো। তারা দেশের মন্ত্রী হতে শুরু করলো। তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে সেটিও আমাদের দেখতে হলো এবং সেই সময় থেকে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমে ক্রমে অবনতি হতে থাকে যার চূড়ান্ত ঘটে যায় ২০০১ সালে। 

সে বছর যখন বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি যার নাম জামায়াতে ইসলাম এবং গং তারা বিএনপির সাথে যৌথভাবে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে জয়ী হলো। সেই ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন – সেটা ছিল আমাদের পার্লামেন্ট নির্বাচন, দেশের জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের পরে আমরা দেখলাম যে, বাংলাদেশ কতো ভয়ংকর একটি দেশে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণা শুরু হতেই আমরা আতঙ্কের সাথে দেখতে শুরু করলাম লক্ষ লক্ষ হিন্দু মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেন। তারা দেশত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার জন্য ভারতের সীমান্তে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন। যে কেউ পুরোটা জানলে ক্লিষ্ট হবেন, কষ্ট পাবেন। সেটি  এমন একটা সময় – মাত্র ২৪ ঘণ্টা বা ৪৮ ঘণ্টার ভেতরে সহস্র সহস্র হিন্দু নারীর সম্ভ্রম লুটে নেয়া হয়েছে। অকল্পনীয়, ভয়ংকর, দুর্বিষহ তেমন একটি সময় আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে। 

দেশের পরবর্তী নির্বাচনে এই মৌলবাদী শক্তি যখন পরাজিত হয়ে গেলো, তখন সেই দুর্বিসহ অবস্থা থেকে সামান্য হলেও আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু আসলে চূড়ান্ত মুক্তি তো ঘটার নয়। ২০০১ সালে রাষ্ট্রের অধিকর্তারা যে কাজগুলো করেছিল তা হচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলবাদকে, উগ্রবাদকে তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল। শিক্ষা ব্যবস্থায় যখন এই পরিবর্তনটি করা হয়, তখন সেটি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করতে থাকে। যার পরিণতিতে আমরা ২০১৩ সালে এসে দেখলাম হেফাজত আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ। আমি তখন ঢাকা শহরে চাকরি করি – ততদিনে আমার ঢাকা শহরে চাকরির বয়স হয়ে গিয়েছে কুড়ি বছর। হেফাজত আন্দোলনের সময় আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করতে থাকলাম যে, সারা দেশের কথা যদি আমি বাদই দেই – ঢাকা শহরেই একজন হিন্দু নারী শাখা পরে, সিঁদুর পরে ঘরের বের হতে পারছেন না, রিকশায় চলাচল করতে পারছেন না। আমার পরিবারেও আমার স্ত্রীকে শাখা খুলে, সিঁদুর মুছে বাইরে যেতে শুরু করতে হলো।

সেটি ঘটেছিল আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কেমন ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা ভাবা যায় না। অবস্থাটি কিন্তু একদিনে বা একবছরে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে হয়েছে। ২০০১ সালের সেই নির্বাচনের আগে থেকেই ষড়যন্ত্রের যে বিশাল জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল, নির্বাচনের পর ক্রমে ক্রমে সেই ষড়যন্ত্র এমন করে ঘনীভূত হতে থাকলো যে দেশটি যেন একটি বিস্ফোরকে পরিণত হতে শুরু করলো। প্রতি শুক্রবার বা জুম্মাবারের নামাজের পরেই বিশাল বিশাল মিছিল বের হতে শুরু করলো। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সমাবেশে হামলা দিয়ে শুরু করে মৌলবাদীরা মোট তেরটি হামলায় ১০৬ জনকে হত্যা করেছিল। আহত হয়েছিলেন সাত শ’র বেশি মানুষ। ২০০১ সালে ঢাকায় নববর্ষের দিনে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে হামলা স্তম্ভিত করে দিয়েছিল দেশবাসীকে। ওইদিন তো আমি নিজেও ঢাকার রমনা অঞ্চলেই ছিলাম। মৌলবাদীদের ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত ঘটলো ২০০৪ সালে যখন ঢাকার মতন একটি শহরে, যেটি বাংলাদেশের রাজধানী শহর, সেরকম একটি জায়গায়, শেখ হাসিনার মতো একজন রাষ্ট্রনেতার ওপর হামলা করা হলো। শেখ হাসিনা, যিনি কয়েকবছর আগেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে হত্যা করার নকশা করতে ওই শক্তি এতটুকুও পিছপা হয়নি।  

২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলন দিয়ে এটি যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো পুরো দেশটি ভেতরে ভেতরে মৌলবাদের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে। সে কারণে পরিস্থিতিটি হয়ে উঠলো অসহনীয় এবং দেশত্যাগ যেন একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে গেলো। 

আমি খুবই সামান্য একজন মানুষ। আমি সারাজীবন ধরেই শিক্ষকতা করে কাটিয়েছি। আমি বলবো একদম মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত একজন মানুষ হিসেবে আমি সবসময় আনন্দেই জীবন-যাপন করেছি। সে-সব নিয়ে আমার কোনওদিন কোনো ক্ষোভ-বেদনা ছিল না। কোনওদিন আমি চাইনি যে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বিলাসী জীবন-যাপন করতে আসবো। আমার বন্ধুরা সেই ১৯৯০–১৯৯১ সালে – যখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছি – প্রথম প্রথম কলেজে বা অন্য জায়গায় চাকরিতে ঢুকছি – সেই সময় থেকে ওরা আমাকে বলতেন, যেহেতু আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ওরা বলতেন আমাকে অন্য দেশে চলে আসতে। বিশেষ করে কানাডার কথা ওরা খুব বলতেন। তখন তো অস্ট্রেলিয়াও আকর্ষণীয় একটি দেশ অভিবাসী হবার জন্যে। কিন্তু কোনওদিনই আমার ভেতরে এ লোভ জাগেনি। আমার মনে হতো যে, আমার জন্মভূমি, যে মাটিতে আমি জন্মেছি, যেই মাটি আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, সেই মাটির কাছে আমার যে ঋণ, সেই ঋণ শোধ করতে হবে আমাকে। আমার কোনওদিন ইচ্ছে করেনি যে, আমি নিজেকে ধনবান করবো, এবং সেটা করার জন্যে দেশকে ত্যাগ করে চলে যাবো। 

আর ২০১৩ সালে যখন চূড়ান্ত সময় – যখন হেফাজতের আন্দোলন চলছে – সে সময় কিন্তু এমনও হয়েছে যে, আমি ফেসবুকে বা ফোনে হুমকি পাচ্ছি। কখনও হুমকি হয়েছে আমার প্রত্যক্ষ ছাত্রের কাছ থেকে। কারণ, সে বছরে ফেব্রুয়ারি-মার্চে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষে গণজাগরণ মঞ্চ নামে যে প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছিল সেটিতে আমাদের সহযোগিতা-সহমর্মিতা ছিল অপ্রতিরোধ্য। আর সে কারণেই মৌলবাদ-বিরোধী আমাদের যে অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমাদের যে দৃঢ় অবস্থান সেটার কারণে পাকিস্তানের তাবেদার রাজাকার-আলবদরদের সমর্থকেরা আমাকেও টার্গেট করেছে। যে ছাত্ররা ক্লাশে আমার সামনে বসেছে একসময়, সেই ছাত্রদের কেউ কেউ একটি মৌলবাদী শক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে। তারা আমাকে হুমকি দিয়েছে যে – “আপনি মনে রাখবেন, আপনার বাসা কিন্তু আমরা চিনি। আপনি  কিন্তু আমাদের থেকে বেশি দূরে নন।” তখন আমি সারাদিন দুঃশ্চিন্তায় থাকতাম, বিপন্ন বোধ করতাম। কারণ সে সময়ে আমার মেয়েটি কেবল স্কুল ফাইনাল মানে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করছে। আমার সব সময় চিন্তা হতো যে, কোন সময় তার জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে যায়। আমি এখন যার পর নাই আনন্দিত যে, তার জীবনে কোনও বিপদ আসার আগেই আমরা চলে আসতে পেরেছি কানাডায়। 

অথচ আমি এমন একজন মানুষ যে কিনা মনে করি প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ধর্ম পালনের যেমন স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনি কেউ যদি মনে করেন তিনি নাস্তিক্যবাদী হবেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেন না – তার সে স্বাধীনতাও রয়েছে। আমি একই সাথে মনে করি পৃথিবীতে যে যেই মতের অনুসারী হোন না কেন, আমরা যদি পরস্পরকে, অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মান দেখাতে না পারি তাহলে চূড়ান্তভাবে এই পৃথিবী আমরা বাসের উপযুক্ত করে রাখতে পারবো না। 

এই প্রসঙ্গে সবসময় আমি আমার জীবনের একটি গল্প বলি। সেটি আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আমার মনে হয় যে সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। গল্পটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী বা অমুসলিম জনগোষ্ঠী। অমুসলিমদের মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠী যেন একটু বেশিই অত্যাচারিত হয়েছিল। তখন হিন্দু জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে সংখ্যায় বা আনুপতিক হারে দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তো প্রকারান্তরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এরকম একটি ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল যেহেতু ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল প্রথম থেকেই। বাংলাদেশের কোটির বেশি মানুষ তো ভারতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই যে ভারত-পাকিস্তান ব্যাপার সেটা তো ১৯৭১ সালের বিষয় ছিল না। ১৯৪৭ সাল থেকেই ছিল – ভারত বিভাগের সময় থেকে। আমরা জানি একটা ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু মজার বিষয় হলো, যেই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হয়েছে, সেই পাকিস্তানের একটি অংশ কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু মানুষ ছিলেন। 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যে চূড়ান্ত আক্রমনটি করে, তাতে যেমন তারা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নিধন করার চেষ্টা করেছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে তাদেরকেও তারা নির্মূল করতে চেয়েছে। একই সঙ্গে এই যে নয়মাস ধরে যুদ্ধ চলেছিল, এই নয়মাস ধরে যুদ্ধের প্রধান টার্গেট হয়ে গিয়েছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। 

তেমন একটি প্রেক্ষাপটেই আমার সেই সম্প্রীতির গল্প। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলার কামারখালী। যুদ্ধ শুরু হলে, সেখান থেকে ২৮-৩০ কিলোমিটার দূরে আমার পিসিমার (আমার বাবার আপন বোনের বাড়ি) বাড়িতে আমরা চলে গিয়েছিলাম। কামারখালী হচ্ছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক, যেটাকে বলা হয়, গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড, সেই রোডের পাশে। তার মানে হচ্ছে, যে কোনও সময় পাকিস্তানি আর্মি চলে আসতে পারে। পাকা রাস্তা তো – মিলিটারি আসার জন্যে সহজ রাস্তা ছিল সেটি। সে কারণেই বাঁচার জন্য আমার বাবা তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে তাঁর বোন অর্থাৎ আমাদের পিসির বাড়িতে চলে গেলেন। সেটি ফরিদপুরেই, তবে অজপাড়াগাঁ। সে জায়গাটাতেই আমরা বেশ কয়েকমাস ছিলাম। 

সকলের জানা যে, বাংলাদেশে মানুষদের কিছু সংখ্যক – যারা ঘোর ইসলামপন্থী তারা –  পাকিস্তানের দোসর হয়ে কাজ করা শুরু করলো। তথ্য আদান-প্রদান করার কাজে পাকিস্তানীদের সহায়তা করতে শুরু করে। এভাবে যারা কাজ শুরু করেছিল, তাদেরকে বলা হতো রাজাকার। বাংলাদেশ কিন্তু এমন একটা দেশ ছিল সে সময়, ওই সময়টাতে হিন্দু-মুসলমানের দূরত্ব যে ছিল না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সম্প্রীতির জায়গাতে বর্তমানে যে চূড়ান্ত ধরনের এনমিটি বা শত্রুতা – অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করতে হবে – সেই রকম পরিস্থিতি বাংলাদেশে ছিল না। আমি যেই স্কুলে পড়তাম, আমার দাদারাও পড়তেন – তো ওই স্কুলের পদার্থ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং বাবার বন্ধু ছিলেন। একসময় তাঁর ইচ্ছা হলো জানতে যে আমরা কোথায় গিয়েছি, কেমন আছি। 

তখন তো ইন্টারনেট, টেলিফোনের যুগ নয়। তাই তিনি সরেজমিনে দেখার জন্য সাইকেল নিয়ে রওনা দিলেন ২৫-২৮ কিলোমিটার দূরের আমাদের খুঁজতে। তিনি আমার পিসির গ্রামের নাম জানতেন, কিন্তু চিনতেন না। পিসিমাদের বাড়ি যেতে পথে তিন-চার কিলোমিটার কোনও ঘরবাড়ি ছিল না। ১৯৭১ সালের পরে আমরাও বারবার গিয়েছি। আমরা তো হেঁটে হেঁটেই যেতাম। পিসির বাড়িতে গেলে আট মাইল হাঁটতে হতো। তাই আমরা হাঁটার দিনে কম গিয়ে বর্ষার দিনে বেশি যেতাম – নৌকা দিয়ে যাওয়ার জন্য। 

সেই স্যারের নাম ছিল ইসলাম। তাঁর পুরো নামটা জানা নেই। সবাই তাঁকে ইসলাম স্যার বলেই ডাকতাম। তিনি যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে ফেললেন। কয়েকজন কৃষককে মাঠে কাজ করতে দেখে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন আমার পিসেমশাইয়ের বাড়িটা কোন দিকে। পিসেমশাই অনেক বড় পরিবারের – জমিদার বাড়ির মানুষ ছিলেন। তাদের অনেক সহায়-সম্পত্তি ছিল। সে কারণে, এদিকে-ওদিকে অনেক দূরের গ্রামের মানুষেরাও তাঁর কথা জানতেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, অমুকের বাড়ি কোথায়? উত্তরে তারা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আবার এ কথাও জিজ্ঞেস করেছেন, ওখানে যাচ্ছেন কেন? তখন স্যার বললেন, ওই বাবুর সম্বন্ধি তাঁর বন্ধু – কামারখালী থেকে এসেছেন। অর্থাৎ এভাবেই গোপন কথাটি ফাঁস হয়ে গেলো। 

এ কথাটি মুহূর্তের মধ্যে রাজাকার বাহিনীতে ছড়িয়ে গেলো যে, অমুক বাড়ির – আমার পিসেমশাইয়ের পদবি ছিল রায় – বলা হলো, রায়বাড়ির যে বিরাট বড়োলোক সম্বন্ধি আছে – তিনি এসে রায় বাড়িতে উঠেছেন। আমার বাবার বোনের স্বামী – তিনি নিজেও বিরাট বড়লোক – মানে জমিদার প্রকৃতির লোক। এ কথাটি প্রচার হয়ে গেলো যে কামারখালী থেকে ওই ব্যবসায়ী বড়োলোক সম্বন্ধি এখানে আছেন। 

ততদিনে পিসিমার বাড়ির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রাজাকারদের বিরাট এক আস্তানা গড়ে উঠেছিল। কয়েকশ মানুষ রীতিমতো বন্দুক নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে পাক আর্মিদের সাথে কাজ করছিল। সেই রাজাকারেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুদের শতশত ঘর-বাড়ি পুড়িয়েছে। ওদের দ্বারা শতশত নারী নির্যাতন হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে – এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে। আমি যে সময়টার কথা বলছি সেটা একদম প্রথম দিককার কথা। তখনও অত্যাচার এতো চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি। ওই জায়গার প্রধান রাজাকারের নাম বাচ্চু রাজাকার। বাচ্চু রাজাকারের কাগুজে নাম আবুল কালাম আজাদ। সেটি অনেক পরে জেনেছি যখন তাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যেত। 

একদিন জানলাম বাচ্চু রাজাকার আসছে পিসিমার বাড়ি আক্রমণ করতে। এক বিকেলে খবরটা এসে পৌঁছল। তখন আমরা সবাই পিসিমার দোতলা বাড়ির ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। আমার মনে আছে, ছাদের উপরে ৫০-১০০টা ইট, ঢাল-সরকি রাখা ছিল কখন বিপদ আসে ভয়ে। পিসিমার বাড়ির প্রতিটি দরজায় কাঠের উপরে লোহার মোটা প্লেট দিয়ে আটকে দেয়া ছিল যাতে কেউ কোনও কিছু দিয়ে সহজে ভাঙতে না পারে। খিলগুলোও ছিল মোটা মোটা লোহার। সেকালে বিল্ডিঙে দেয়াল তো ৩৫-৪০ ইঞ্চি ছিলই – সেসব এখনও আমার স্মৃতিতে ভাসে। তখন আমার বয়স ছিল ছয় থেকে সাড়ে ছয়। 

আমরা ছাদের উপর থেকে দেখছি কয়েকশ মানুষ আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘিরে আছে। আর কিছুক্ষণ পর পর হাঁক দিচ্ছে। তারা সবাই পিসিমাদের আশপাশের গ্রামের মানুষ। এরা সবাই কিন্তু মুসলমান। তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন পিসিমাদের এবং আমাদের পরিবারকে রক্ষা করতে। কয়েক শত মানুষ সারারাত ঢাল, মশাল, তরবারি নিয়ে বাড়ির চারপাশে হাঁক দিচ্ছে। ফলে বাচ্চু রাজাকার আর ওখানে আক্রমণ করতে সাহস পায়নি। দুইটি হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে কয়েক শত মুসলমান পরিবারের মানুষেরা তাঁদের জীবন বাজি রেখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার কাছে এটি ধর্মে ধর্মে সম্প্রীতির সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আমার জীবনের। 

এ প্রসঙ্গে আরও একটু এগিয়ে যাই। যখন জানা গেলো রাজাকাররা সবাই জেনে গেছে পিসিমাদের বাড়িতে আমাদের অস্তিত্ব, তখন আমাদের পরিবারকে সরিয়ে দেয়া হলো। সরিয়ে কোথায় দেয়া হলো? আমার বাবাকে একটি মুসলমান পরিবারের ভেতর দিয়ে দেওয়া হলো। এই জন্যে আমি বলি ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য একই সাথে একটি উন্নয়নমূলক ঘটনা। কারণ, ৭১ সালের আগে বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার ছিল। তাঁরা মুসলমানদের কোনও ছোঁয়া খেতেন না, মুসলমান মানুষকে ঘরে প্রবেশ করতে দিতে তাঁদের অনেক আপত্তি ছিল, এ রকমের হাজার ব্যাপার ছিল। এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। 

কিন্তু ৭১ সালে কী হয়েছে – হিন্দু মানুষেরা বাধ্য হয়ে মুসলমানদের পরিবারের মধ্যে ঢুকেছে, রান্না খেয়েছে এবং নয়মাস ধরে এ রকম চলতে চলতে তাঁদের এই কুসংস্কার ক্রমে ক্রমে ভেঙে গেছে। এটা আমি এই জন্য বলছি যে, আমার বাবা তিনি একটি মুসলমান পরিবারে গিয়ে থাকলেন। আমার বাবাও তো চেতনাগতভাবে ১৯৭১-এর আগে অন্য আরও হিন্দুদের মতোই ছিলেন। পরবর্তীকালে আমি দেখেছি, আমার বাবার বন্ধুরা পুজোয় যখন আসতেন ঘরে নিয়ে তাঁদেরকে খেতে দেয়া হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। 

বাবা যে ওই মুসলমান পরিবারে ছিলেন, সেখানে তো তিনি ওই পরিবারের নারীদের রান্নাই খাচ্ছিলেন। তার ফলে কী হচ্ছিল, তাঁর মধ্যে কুসংস্কার কাটতে থাকে। আমার বড়োভাইকে আর একটা পরিবারে দেয়া হয়েছিল। কারণ, তিনি তখন বড় হয়ে গেছেন, যদিও তিনি তখন ১০ম শ্রেণিতে পড়তেন। তখন তো তিনি যুবকপ্রায়, আর সে সময় কোনও যুবককে রাজাকাররা বাঁচিয়ে রাখতো না কারণ তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারে। আর আমরা – আমাদের মা, মেজদা এবং বাকি সব ভাইবোনকে নিয়ে অন্য আর একটি মুসলমান পরিবারে গিয়ে উঠেছিলাম। 

তিনটি পরিবারে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে উঠেছিলাম। আর তিনটি পরিবারই মুসলমান – তারাই আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। তারপরে সেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো। সেটি হচ্ছে, আমরা একটি পরিবারে আছি, খেলছি, দুলছি। তখন তো হাফ প্যান্ট পরে থাকি। একদিন হঠাৎ করে ভোরবেলায় জানা গেলো বাচ্চু রাজাকার আসছে। দেখা গেলো ২০-৫০ জন মানুষ আমার বাবাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে নিয়ে আসছে। আসল ঘটনাটি হচ্ছে ওরা খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল বাবার। পরে বাবাকে নিয়ে একটি গাছের সঙ্গে তারা বাঁধলো। তারপর মা-সহ আমাদের পরিবারের সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হলো – গুলি করার জন্যে। এই যে ঘটনা ঘটছে, সেই কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশের গ্রামগুলোতে মাতব্বর ধরনের যে মানুষেরা ছিলেন তাঁরা ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসলেন বাবাকে বাঁচানোর জন্যে যেহেতু তাঁরা জানতেন রায়বাবুর সম্বন্ধি তিনি।

এইসব মনে পড়লে আমি অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। তো ওই যে মাতব্বর ধরনের মানুষ – তারা কী কী ভাবে আমাদের পরিবারের সাথে সংযোগ হয়েছিলেন আমি জানি না। আমাদের যতো ধন-সম্পদ ছিল তার বিনিময়ে আমাদের বাঁচালেন। এরপর আমার আর কিছু মনে নাই, তারা আমার বাবাকে ছেড়ে দেয়। কোথায় নিয়ে যায় আমার মনে নেই। এরপর কোনও একটা সময় ফরিদপুরের সেই অজপাড়াগাঁ থেকে একটি নৌকায় অন্য একটি পরিবারের সাথে আমার মেজদা – যে দাদা ২০২০ সালের ২৭ জুলাই পাঁচ মিনিটের নোটিশে মারা যান – এবং আমি চলে যাই ভারতের বনগাঁতে। আমি গল্প করি – এই যে সম্প্রীতির জায়গা, এটা প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের চিত্র। সবসময় সম্প্রীতির ঘাটতি হয়েছে রাজনীতির কারণে, রাজনীতিকরা মানুষকে উস্কিয়ে দিয়ে সম্প্রীতিকে সরিয়ে একটা কুৎসিত জায়গায় নিয়ে যেতো। ফলে আমরা একজন মানুষকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হতাম। 

পরবর্তীকালে এই রাজনীতিটা বিশেষ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের মর্মমূলে বিঁধে গিয়েছিল। বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ – তারা যেন স্বাভাবিকভাবেই একটা সাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী হয়ে গেছে। মানে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে সরে গিয়ে বিরাট একটা অধঃপতন হয়ে গেছে। যার ফলে, বঙ্গবন্ধু – তিনি নিহত হয়েছিলেন ’৭৫ সালে – ১৯৭৫ এর পর বাংলাদেশে গত ৪৫-৪৭ বছর ধরে প্রায় প্রতি বছরই একটি-না-একটি বড়ো ধরনের সাম্প্রদায়িক অত্যাচার ঘটে। একেক সময় আমরা দেখি একেক জায়গায় দুই পাঁচ শ বা হাজার ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। পঞ্চাশ-এক শ নারী ধর্ষিত হয়ে যান। মুহূর্তের ভেতরে, রাতের ভেতর হাজার মানুষের ধন-সম্পদ লুটে নেয়া হয়, বাড়ি ঘরে আগুন দেয়া হয়। একটা অজুহাত পেলেই বাংলাদেশের কিছু মানুষ বিভিন্ন জায়গায় এটা করার জন্য যেন মুখিয়েই থাকে। 

আমি টরন্টোতে এসেছি ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে। ওই মাসের শেষ বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি এখানে একটি মন্দির দেখতে যাই। জানলাম সেই মন্দিরটির নাম বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দির। আমার একজন বন্ধু আমাকে সেই মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার ধারণা সেদিন কোনো ছুটির দিন ছিল না। কার্যদিবসে সাধারণভাবে বিশেষ কোনও পুজো না থাকলে লোক সমাগম হয় না। ভিতরে ১০ থেকে ১৫ জন ছিলেন। একটি বড়ো স্থাপনা। এটার ভেতরে ঢুকে সত্যি সত্যি আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, ও আচ্ছা! পৃথিবীতে এমন জায়গাও আছে যেখানে হিন্দু মানুষরা বসে নিরাপদে কীর্তন করতে পারে? আগে আমার যেন কেন মনে হতো – সারা পৃথিবীতে কোনও একটি জায়গা নেই যেখানে হিন্দুরা নিরাপদে তাদের ধর্ম আচরণ করতে পারে। 

আমি নিজে ধর্ম আচরণের ব্যাপারে অতটা একনিষ্ঠ নই। এটা আমি বার বার অনেক জায়গায় বলেছি। কিন্তু আমার কথাটা হচ্ছে একজন মানুষ যদি ধর্ম আচরণ করতে চান, তাঁর জন্য এটি নিশ্চিত করতে হবে। সেই জায়গাতে বাংলাদেশে এতো বিঘ্ন আমরা দেখতাম, মানে বিষয়টি এমন হয়ে গিয়েছে – কেউ পূজা করতে যাচ্ছে, মানেই হচ্ছে কোনও একটা বাঁধা, একটা দ্বিধা, একটা কিছু। 

আমরা যখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স বা সেভেনে ছিলাম। আমার দিদি তো আমার চেয়ে দুই বছরের বড় – মানে তিনি এইট বা নাইন ক্লাসে। অর্থাৎ তিনি তখন কিশোরী বয়স পার করে তরুণী হওয়ার প্রথম পর্যায়ে। সেই সময়গুলোতে দেখতাম আমার বড়ো ভাই, মেজ ভাই ও বাবার কতো উৎকণ্ঠা তাঁকে নিয়ে। সেই উৎকণ্ঠা এ জন্য বলছি যে, সে সময় পুজোতে দিদিরা নিশ্চিন্তে মণ্ডপে যেতে পারতেন না। কামারখালী বাজারে আমাদের বাড়ি থেকে পূজা মন্দিরে যেতে দেড় মিনিট সময় লাগে। তার ভিতরেও কতো উৎকণ্ঠা, নিরাপত্তাহীনতা। আমরা সবসময় দেখতাম যখনই কোনও বড়ো পূজা হতো – স্বাভাবিকভাবেই সেখানে হিন্দু পরিবারের মেয়েরাও আসতো। কিন্তু বাস্তবতা কী? 

কিছু মানুষ মন্দিরের গেটে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো – সেটা ছিল পরোক্ষ বাধা প্রদান – মেয়েদের সহজে মন্দিরে যেতে দেবে না। ওই মানুষগুলো এমনভাবে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতো যে ভেতরে মেয়েরা ঢুকলে তাদের গায়ের সাথে লেগে ঢুকতে হবে। এই যে একটা উৎকণ্ঠা, যিনি এটি কঠিনভাবে উপলব্ধি করেননি তিনি অনুভব করবেন না। পরে আমি নিজে তখন কলেজে পড়াই ঢাকাতে, তখন আমার মেয়ের বয়স ১১-১২ বছর। এটি ২০০৭-৮ সালের দিকে। এর আগে ১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে আমার গ্রাম কামারখালীতেই কলেজে দেড় বছর অধ্যাপনা করেছি। কলেজের আমি যেহেতু ইংরেজি অধ্যাপক ছিলাম, অত্র অঞ্চলের সব মানুষ আমাকে চিনতেন। তারপর আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি যার ফলে আমার পরিচিতিও বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়াও আমার বাবার কারণেও আমাকে অনেকেই জানতেন। কারণ, আমার বাবা বেশ পরিচিত একজন মানুষ ছিলেন সারা জেলাজুড়ে। 

২০০৭ সালের দিকে আমার মেয়েকে একবার দুর্গাপূজার দশমীতে কামারখালীতে নিয়ে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, আমরা কৈশোরকালে কীভাবে দশমী করতাম সেটি মেয়েকে দেখানো। গড়াই নদী তীরবর্তী আমাদের কামারখালী বাজার। দশমীর পূজা হয়ে গেলো দুপুরের দিকেই – মানে দেবতা বিসর্জন হয়ে গেল। বিকেলে প্রতিমা বিসর্জন।  আমি প্ল্যান করছিলাম কীভাবে ঠাকুর বিসর্জন দেয় সেটা আমার মেয়েকে দেখাবো। এলাকার অনেক মানুষ মিলে প্রতিমা নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে। আমিও মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি মানুষদের সাথে সাথে। নদীর ঘাটে যখন ঠাকুর পৌঁছল তখন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। আমার মেয়ে ঢাকায় থাকে, ঢাকার স্কুলে পড়ে – সে একটু বেশি পরিপাটি ও স্মার্ট দেখতে। একটা পর্যায়ে আমি অনুভব করতে শুরু করলাম আমি ও আমার মেয়ের চারপাশে কিছু পনেরো বিশ বছরের তরুণ ঘুরছে। আমি বুঝতে পারছিলাম তারা কোনও না কোনও ছুতোয় আমার মেয়ের শরীর স্পর্শ করতে চাইছে। যখন তাদের প্রবণতাটা বুঝতে পারলাম তখন আমার মনের ভেতর অনেক ক্ষোভ ও ঘৃণা জাগলো। ততদিনে তো আমার বয়স ৪৩ পার হচ্ছে। যেই এলাকার মানুষ আমি, যে গ্রামে আমি কাটিয়েছি কতগুলো বছর, শত শত মানুষ আমাকে জানেন – সেই আমার মেয়ে এসে যদি এই নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে তাহলে যিনি একজন প্রভাবশালী মানুষ নন তার কন্যাটি কতটা নিরাপত্তাহীন? এই ভেবে আমি সিদ্ধান্ত নেই আর কোনওদিন আমার মেয়েকে আমি কামারখালীতে পুজা দেখাতে নিয়ে যাবো না এবং আমি আর কোনওদিন নিয়ে যাইওনি। 

যেই গ্রামে আমি পুজোতে বা আরও কতো কাজে যুক্ত ছিলাম একটা সময়, সেই গ্রামের প্রতি, সেই মাটির প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেলো ওই এক ঘটনাতে। যদি বাংলাদেশের কোনও বন্ধু, কোনও পাঠক আমার এই লেখাটি পড়েন তাকে আমি অনুরোধ করবো এই বিষয়টি মর্ম থেকে অনুভব করার জন্য। কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন কোনও মুসলমানের মেয়ে কী এরকম অত্যাচারের শিকার হয় না? হয়, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু মেয়েটি যদি একজন হিন্দু হয়, তাহলে সেটির সম্ভাবনা দশ-বিশ গুণ বেড়ে যায়। এমন আচরণগুলো একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের মধ্যে কতটা বিরূপতা তৈরি করে দিতে পারে সেটা অনুধাবন করার জন্য আমার পাঠকদের অনুরোধ করবো। এই আচরণ পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাকে ধ্বংস করতে কতটা কঠিনভাবে কাজ করে তা বলে বোঝানো যাবে না। 


No comments

FACEBOOK COMMENT