দীপংকর দে
প্রসঙ্গ চট্টগ্রামের লোক গান ও সংস্কৃতি
দীপংকর দে
জীবনের প্রয়োজনেই শিল্প সংস্কৃতির সৃষ্টি। এ প্রয়োজন একক ব্যক্তির স্বতন্ত্র প্রয়োজন নয়, সমষ্টি জীবনের সামাজিক প্রয়োজনই শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা। শিল্প তাই নৈর্ব্যক্তিক নয়, সামাজিক। মানুষের সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি শিল্পে পরিস্ফুটন হবেই। যে শিল্পের সঙ্গে সামাজিক জীবনযাপনের সংযোগ নেই ,তার মধ্যে অমরত্বের অঙ্গীকার নেই। মানব সমাজের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, তাই মানব-সংস্কৃতিরও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে।ব্যাপক অর্থে ধরলে মানুষের জীবনযাত্রাই শিল্প, সংগীত তার অন্তর্ভূক্ত।
মানুষের চলাচল রয়েছে গোটা গোলক জুড়ে ইতিহাসের সেই প্রাচীন সময় থেকে, সেই চলায় সহ-পথিক হয়েছে তাঁর গানও। জাতিতে জাতি যেভাবে মিশেছে সেভাবে মিশেছে গান। মানুষের চলা যদি নদীর মত পাগলপারা হয়, তবে গানের চলা গভীর চলা। কখনো বহিরঙ্গে স্থূলভাবে কোনও কোনও চলার চিহ্ন হয়ত পাওয়া যায়। কিন্তু সুগভীরে ধারনা করা পদরেখায় মিশে থাকে নানা সভ্যতার নানা মেলামেশার অসংখ্য স্মৃতিচিহৃ।কত কান্নাহাসি কত সুখদুঃখ কত উচ্ছাস দীর্ঘশ্বাস ধারন করে আছে আমাদের গানের অন্তরমহল। এক অর্থে গানের চলাই মানুষের চলা। গানের ইতিহাসেই নিহিত মানুষের ইতিহাস।
ভৌগলিক বিচারে চট্টগ্রাম একটি জেলা হলেও শিল্প ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এর স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যার অন্যতম প্রধান বিষয় হলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে।মহর্ষি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মতে; বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের আগমনে পালিভাষা, আরাকানিদের আগমনে আরাকানি মঘী ভাষা, মুসলমানদের আগমনে আরবি ও ফারসি ভাষা, পর্তুগিজদের আগমনে পর্তুগিজ ভাষা, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রাদেশিক উপভাষা, ইংরেজদের আগমনে ইংরেজি ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার সাথে চট্টগ্রামের ভাষার সংযোগ ঘটেছে। নানান জাতি গোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দ ভান্ডারে সমৃদ্ধ এই ভাষা রৃপরীতি ও বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের অপরাপর আঞ্চলিক ভাষাকে ছাড়িয়ে আজ উপমহাদেশে ভাষাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ভাষার ব্যাপক বিস্তৃত শ্রেণিবলয়ে আঞ্চলিক শাখার কেন্দ্রবিন্দুতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অবস্থান। এ আঞ্চলিকতা ঐতিহাসিক ও নৃ-তাত্ত্বিক আঞ্চলিকতা।চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এখানকার আঞ্চলিক ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ সাহিত্যকর্ম। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত, সুরারোপিত এবং গীত এ সব গানে চট্টগ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের জীবননানুভূতির স্পর্শকাতর দিকটি ফুটে ওঠেছে। এ সব গান শুধু যে আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ তা নয়,জাতীয়তার প্রতীক হয়ে এ অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারাপাঠ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যেমন ঘরানা, লোক সংগীতের ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন বাহিরানা'-র কথা। 'বাহিরানা' মানে আঞ্চলিকতা। একটি অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, বাগধারা, অর্থনীতি, রাজনীতি,সেই অঞ্চলের গানকে বিশিষ্টতা দেয়। একটি অঞ্চলের আবহমান ইতিহাসের গায়ে জন্ম নেয় সেই অঞ্চলের লোকসুর ও গান, এ সব গানে একটি অঞ্চলের ভাষাই যেন ফুটে ওঠে। আধুনিক গানের সুর ব্যক্তি প্রতিভার সৃষ্টি। অন্যদিকে, একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের চলন সুনির্দিষ্ট হয় তার ঘরানার দ্বারা। লোকগান বা বিশেষত আঞ্চলিক গানের ক্ষেত্রে স্রষ্টা একটি অঞ্চলের লোকসমাজ। শুধু সুর নয়,গানের কবিতার চিত্রকল্পেও দেখি আঞ্চলিকতারই স্বাক্ষর। আমাদের লোকগানের ঘরের বঁধু রাধা বা ও মাঠের রাখাল কৃষ্ণের ছবিটি ভিন্ন ভিন্ন। উত্তর বঙ্গের গানে মাহুত বা মৈষাল হয়ে যায় কখনো। সিলেটের গানে কৃষ্ণ হয়তো নদীর মাঝি। একটি কয়লাখনির লোকগানে বলা হচ্ছে , কৃষ্ণের গায়ের রঙ কালো কারন সে কয়লা খনিতে কাজ করে। আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে সাম্পানমাঝি, রিকশাওয়ালা কিংবা মলকাবানু , আল-কুমারী নিজেরাই সর্বেসর্বা হয়ে নিজেদের আসনে আসীন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে কথা ও সুরে একটি ভূগোলের সমগ্র ইতিহাসেরই উদ্ভাসন রয়েছে।
সমতল চট্টগ্রামে তিনটি পর্বতশ্রেণী উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরালভাবে অবস্থিত।পশ্চিমে মহেশখালী-কক্সবাজার পর্বতশ্রেণী, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্বতশ্রেণী এবং উভয়ের মধ্যে সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি, মহামুনি করলডেঙ্গা, পটিয়া , সাতকানিয়া পর্বতশ্রেণী অবস্থিত। অনুচ্চ দেয়াং পার্বত্য অঞ্চল প্রাচীন শিলা দ্বারা গঠিত।
চট্টগ্রামের প্রধান নদ-নদীগুলো হলো কর্ণফুলী, ফেনী,শঙ্খ, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী।চট্টগ্রামের পশ্চিম সীমা সমুদ্র দ্বারা বিধৌত। এই দীর্ঘ তটরেখায় সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। চট্টগ্রাম নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর অন্তর্গত।মৃদুভাবাপন্ন আবহাওয়া, সমুদ্র সন্নিহিত হওয়ায় চট্টগ্রামের আবহাওয়া ততটা গরম নয়, শীতকালে শীতের প্রখরতাও কম।
মনোরম ভূ-প্রকৃতি,নদ-নদী ও জলবায়ুর এমন বৈচিত্র্যময় গঠনশৈলী চট্টগ্রামের মানুষের সামাজিক জীবনের মানসিক ও শারীরিক গতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলের গানের সুর তাল লয় লোক মানসধর্মী ও জীবনঘনিষ্ট । এ সকল গানের সুরে যেমন তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তেমনি এর ছন্দ, গায়কী ঢং ,তালের বিচিত্র গতি স্বাতন্ত্র্যের দাবী রাখে। চট্টগ্রামের গানে ঠাটের ব্যবহারে বিলাবল, খাম্বাজ ও কাফির প্রাধান্য । অপরদিকে তালের ব্যবহারে কাহারবা, দাদরা ও তেওড়ার প্রচলন উল্লেখযোগ্য।স্বরের প্রয়োগে মধ্যযুগীয় এক-দ্বি-ত্রিস্বরিক এর পাশাপাশি বিংশ শতকে চতুর-পঞ্চ স্বরিক চলন লক্ষণীয়। কখনও মীড় কখনও গমক, আবার মীড় গমকের মিশ্রণে জীবনছন্দে প্রবহমান এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন।
চট্টগ্রামের আপামর জনগোষ্ঠী উদ্বেল প্রাণের চঞ্চলতায় কঠোরতম জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার প্রেরণায় উত্তাল সমুদ্র ও দৈব দুর্বিপাকের সাথে লড়াই করে এসেছে যুগে যুগে। মগ-হিন্দু-মোগল-পাঠান-দিনেমার-পর্তুগিজ-ইংরেজ এই জাতি সমূহের ঐতিহাসিক ঘাত প্রতিঘাত কেন্দ্, হিন্দু- মুসলমান-বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান ধর্মের সংযোগস্থল, পীর আউলিয়া-বুজর্গ, সাধু-সন্তদের সাধনার পীঠস্থান অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামকে শিল্পী কথা ও সুরের বন্ধনে গেঁথেছেন এভাবে-
'ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান
দইজ্জ্যার কূলত বসত করি
সিনা দি ঠেগাই ঝড় তুয়ান।
পাহাড় পর্বত সাইগর নদী পরানত দেয় দোলা
মিন্নতগরি ফসল ফলাই আঁরা ভরাই সোনার গোলা
ফুরুত ফুরুত হাসি ফুডাই গলাত তুলি গান।
আরবি পর্তুগিজ ওলন্দাজ ফরাসি মগ ইংরাজ
কত রইম্যা লেখি গেইয়ে আঁরার ইতিহাস
বার আউলিয়ার আবাসভূমি আঁরার চট্টগ্রাম।(কথা ও সুর: মলয়ঘোষ দস্তিদার)
কর্ণফুলি- একটি নদী, একটি জনপদের নাম।পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে উৎপত্তি লাভ করে 'কর্ণফুলি নদী' চট্টগ্রামকে দুইভাগ করে যুগে যুগে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। তার প্রবহমানতা দুইকুলে জন্ম দিয়েছে নানা কাহিনী ও আখ্যান। ঝর্ণার চলার পথের কথাচিত্র হয়ে কর্ণফুলি জীবনছন্দে সুর তাল লয়ে মেতেছে শিল্পীর কন্ঠে;
ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত
লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে
যার গই কর্ণফুলি।
এককূলদি শহর বন্দর নগর কত আছে
আরেক কূলত সবুজ রোয়ার মাথাত
সোনালি ধান হাসে
গাছর তলাত মলকাবানুর গন
গোরপ পোয়া গায় পরান খুলি।
কত না গিরস্তের বৌ ঝি পানি নিত যায়
কত পাখি গাছর আগাত বই কত গন হুনায়
হালদাফাডা গান হুনাইয়া মাঝি
সাম্পান যার গই পাল তুলি।
পাহাড়ি কঅন সোন্দরী মাইয়া টেউঅর পানিত যাই
সিয়ান গরি উডি দেখের কানর ফুল তার নাই
যেইদিন কানর ফুল হাজাইয়ে
হেই দিনত্তুন নাম কর্ণফুলি। (কথা ও সুর: মলয়ঘোষ দস্তিদার)
চট্টগ্রামের ঘুমপাড়ানি গানে এ অঞ্চলের মায়েদের স্নেহপরায়নতার পাশাপাশি প্রিয়জনের দূর-দূরবিদেশগামীতার কথাও অন্তরের গহীনে কড়া নাড়ে। আমার মা স্বর্গীয় তরুবালা দে আমার ছোটভাই(প্রদীপ) ও ছোট বোনকে (বলাকা) আঁচল দিয়ে ঢেকে বুকের দুধ পান করাতে করাতে নিমগ্নচিত্তে নিম্নোক্ত ঘুমপাড়ানি গানটি টানা মীড় দিয়ে গেয়ে যেতেন। আর আমি তন্ময় হয়ে পাশে বসে শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার মা এটি তাঁর মা(আমার দিদিমা স্বর্গীয় শ্যামাদেবীর কাছে শুনেছিলেন।
'ও ঘুম যারে দুধর সাইরলে
অ সাইরলে ঘুম যারে তুই
ঘুমত্তুন উডিলে সাইরলে
অ সাইরলে বচ্চু দিয়ম মুই।
উতত্তুন আইয়েরলে তোতা
অ সাইরলে দইনে যাইব ফিরি।
রোহাইংগ্যা রোহাং যারগই
অ সাইরলে তোর লায় আইন্যম কি।
বাঁকখালীর পানিরে কালা
অসাইরলে কালা তোর বাপর মন।
মাতৃভাষার জন্য আত্মবলি দান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুখের ভাষার আন্দোলন ৫২'র একুশে ফেব্রুয়ারির রক্ত ঝরানো দিনটির কথা বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে তা এসেছে এভাবে-
'ন কাঁদিস ন কাঁদিস অ মা
ন ফেলাইস চোগর পানি
বুগর রক্তত তোর পোয়ায় দিয়ে
মুখর ভাষা আনি
আঁরার মুখর ভাষা আনি-----'
(কথা ও সুর: আবদুল গফুর হালী)
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ মানচিত্র। এ মাটি ও মানুষের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সন্তান হারানো মায়ের আহাজারি গগনবিদারী কান্নার রোল হয়ে উপচে পড়ে কর্ণফুলী অববাহিকায়। এখনও দুই কূলে সন্তানের জন্য মায়ের অপেক্ষার পালা শেষ হয় না।
'শহীদর মা কান্দেল্যে বটগাছ তলে বই
বেয়াগগুনর পোয়া ফিরি আইস্যে আঁর পোয়া কই।
পঁচিশ বছর বয়স অইয়েল চাঁদর মত মুখ
সোয়ামি হারাই মনে গইয্যেল পুতে দিব সুখ
দারন যুদ্ধে সুখর ঘরগান ভাঙি গেইয়ে গৈ।' (কথা ও সুর: আবদুল গফুর হালী)
সাম্পানওয়ালার সাথে এ অঞ্চলের নারীর প্রেমানুভুতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক নরনারীর চিরায়ত প্রাণরসায়ণের ধারায় ব্যাকুল হয়ে সমাজ জীবনে নানা আখ্যান সৃষ্টি করেছে।সাম্পানওয়ালার অদম্য সাহস,প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ের অফুরান শক্তি,জীবনবোধ নারী হৃদয়কে তোলপাড় করেছে;
পালে কি রং লাগাইলো রে মাঝি
সাম্পানে কি রং লাগাইলো
শঙ্খ নদীর সাম্পানওয়ালা
মোরে পাগল বানাইলো
জোয়ারে আসিল সাম্পান রে
ভাটির টানে আবার কই গেল।
তেল কাজলা রইস্যা মাঝি
সাম্পানেতে থাকি
দইনালী বাতাস পাইয়ে
সর দিয়ে টাঁকি
পিন পিনাইয়া সিন সিনাইয়া রে সাম্পান ঘাটে আসিল।
ভিন গেরামর অচিন মাঝি
আঁর দেখা পাই
আঁর মিক্যা রইয়ে চোগ পাগাই
দরশনে দুই মনে রে
প্রেমের ছেল যাই বিঁধিল। (কথা ও সুর: কবিয়াল ইয়াকুব আলী )
সাম্পান মাঝির অদম্য সম্মুখ চলার গতি এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রবহমানতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের তোয়াক্কা না করে নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে দূর যাত্রায় এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে নোঙর করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়াই সাম্পানমাঝির লক্ষ্য নয়, মনের মানুষের খোঁজে সে ও যেন কাঙাল হয়ে ফিরছে আজকে এ ঘাট তো কালকে ও ঘাট;
বাঁশখালী মইশখালী
পাল উড়াইয়া দিলে
সাম্পান গুড়গুড়াই টানে
আয় তোরা কন কন যাবি
আঁর সাম্পানে
কর্ণফুলীর মাঝি আঁই
নিয়ম ভাডি উজানে।
অল্প বসর নয়া মাঝি আঁই
পইসা কড়ি থাইলে দিবা
কন চিন্তা নাই
আঁই কিয়র আশায় সাম্পান চালাই
কেঁয়াই ন জানে।
বাড়ির পিছে পাডি পাতার ঝাড়
থামি পিন্দি আড়ালত থিয়াই
কন সুন্দরী চাআর
তার মনর কথা কইব পান লার
আঁখির টানে।
সদরঘাট আর চাক্তাই ধরি
হক্কল ঘাড়ত সাম্পান লই যাই
ঘুরি ফিরি
ন পাইলাম আঁর মনর মানুষ
ন বুঝের মনে।(কথা ও সুর:সনজিত আচার্য)
দৈনন্দিন জীবনে ঘর গৃহস্থালির ব্যবহারিক জিনিসপত্রের প্রয়োজনীয়তা কৃষিনির্ভর এ সমাজে অপরিহার্য। ডালা,কুলা, চালইন - এই তিনটি কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে কিভাবে ওতেপ্রাতভাবে জড়িয়ে আছে তা এ গানের মূল উপজীব্য বিষয়;
ডালাকুলা চালইন লইবানা অবা
ডালাকুলা চালইন----
চালইন চালের চালের
চালইন ঘুরের ঘুরের
উ-রে মল্লুক্ষা ধান
নিচ দি চইল পরের।
চইলর হঙ্গে ধান পরি যায়
হেই বদনামি নাই
চৌদ্দ পুরুষ কাডাই দিলাম
চালইন বানাই।
ডলু বাঁশর কুলা আঁর
জায়ত বেতর বান
উড়ি যাইব ধুল ধুঁরা
কুলাত যাইব ধান।
মাঅল বাঁশর চাকদি বাঁন্ধি
কি সোন্দরয্যা ডালা
হক পয়সা দি কিনি লইবা
যার যিয়ান লায় ভালা।
একখান লরে একখান ঝারে
আর একখানে ঘুরে
তিন্নান জিনিষ যারত লইবা
হেই গিরস্থি ভরে। (কথা ও সুর: শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব)
মা-বাবা, ভাই-বোনের রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে এক সময় বৈবাহিক বন্ধনসূত্রে শ্বশুর বাড়িতে জামাইয়ের সাথে অবস্থান করতে হয়।কিন্তু কি যে এক অদৃশ্য এক টান,ভাই-বোনের মায়া মততার এ বন্ধনটি ছিন্ন হতে দিতে চায় না। এ যে ভাইয়ের প্রতি বোনের,বোনের প্রতি ভাইয়ের অন্তরাত্মার অবিচ্ছেদ্য এক স্নেহ ও প্রীতির সম্পর্ক- যা এ গানের কথাচিত্র হয়ে আছে;
ক্যাঁ কোরত ক্যাঁ কোরত
চাম্মান অলা ক্যাঁ কোরত
ক্যানে যাইয়ম বববুরত
বরবুজ্জামাই তিয়াই রইয়ে
ঘাঁড়ার দুয়ারত।
জামাইর কথা দোচরা
দুরুচ কুরা মোচরা
আঁরে দেখি বববুজ্জামাই
যার গৈ বাজারত।
বববুর বাড়ি বউত দূর
কিনি লইয়ম চিড়াগুড়
দইজ্জ্যার কুলত সাম্পান ভিড়াই
চধিরি আঁড়ত।
বববুর পোয়া মনাইয়া
খুব বেশি ননাইয়া
আঁরে দেইলে ঝাপটাই ধরি
উডিব কোলত। (কথা ও সুর: এম এন আখতার)
চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতিতে আপ্যায়ন, ঐতিহ্য রক্ষা, রসবোধ, রোমান্টিকতা ও প্রেমানুভুতির উপলক্ষ হিসেবে পানের ব্যবহার নান্দনিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্যে অনন্য এক স্থান দখল করে আছে।
যদি সোন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম
মইশখাইল্যা পানর খিলি তারে বানাই খাবাইতাম
একদিনর লাই কাছে ডাকি রসের পীরিত শিখাইতাম।
নয়া মুখর নয়া কথা শুনিতে সুন্দর
মাঝে মাঝে পান চাবাইত হাসির ভিতর
প্রেমর মালা দোনো হাতে তারি গলায় পরাইতাম।
রসের কথা রসের পিরিত যদি না জানে দুইয়ান একখান কইতাম তারে প্রেমের কারনে
নর নারীর হাউসের পিরিত কি মজা তারে বুঝাইতাম।(কথা ও সুর: এম এন আখতার, শিল্পী:শেফালী ঘোষ)
বিচ্ছেদের সুরে এ সমাজ ব্যাকুল হয়েছে প্রতিনিয়ত। বিয়োগান্তক নানা ঘটনায় জর্জরিত হয়ে বিচ্ছেদের সাগরে ভেসেছে বার বার। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, প্রিয়জনের বিরহে, স্বজন হারানোর বেদনায়, দৈনন্দিন দুঃখানুভুতিতে মিলন বিরহের সুর করুণ হয়ে ধরা দিয়েছে এ গানে;
সূর্য উঠের লে ভাই লাল মারি
রইস্যা বন্ধু ছাড়ি গেল গই
বুগত ছেল মারি।
শঙ্খ খালর কূলর উয়র রইস্যা বন্ধুর ঘর
লাগত পাইলে কইও তারে (মোর) পরানের খবর
নিদয়া বন্ধের জ্বালায় রে পরান আমার যায় ছাড়ি।
শঙ্খ খালর পানি রে কালা কালা দুশমন
তার্তুন অধিক কালা (অ ভাই)
পাষান বন্ধের মন
ফিরিয়া ন চাইল বন্ধুরে অবলারে গেল ছাড়ি।
কইও কোকিলা বন্ধু পাষান বন্ধুর ঠাঁই
এতদিনে পিরিতির নারী (তোমার) এ জগতে নাই
পাইলে একবার কইও বন্ধুরে মরা মুখখান চায় তারি। (কথা ও সুর: অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, শিল্পী শেফালী ঘোষ)
যৌবনের মাদকতা, উন্মাদনা ফুরিয়ে, মধ্য বয়সী নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত মানব মানবী জীবন সায়াহ্নে পারস্পরিক সহযোগিতা সহায়তা বাড়ায় একে অন্যের প্রতি। এ হাত অন্তরাত্মা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রেমানুভুতি ও সহানুভূতির হাত। এ যেন মরমে মরমে বেজে ওঠা কথা ও সুরেরই আলিঙ্গন। আহ! হৃদয়ের দোসরের জন্য এ কেমন প্রাণের আকুতি;
নানা গেইয়ে শহরত নানি যাই থিয়াই রইয়ে ঘাঁডার দুয়ারত
নানি চিন্তা গরের বুড়া মানুষ কেএনে আইব এই শীতত।
নানার মনত নাই
যাইবার সমত চাদরগানও গেইয়ে গই ফেলাই
শীত পড়েয্যে ছিরি ছিরি যেএন নাকি কাল ছরত।
নানি ভাত পানি ন খার
নানার খবর পোছার গরের যারে লাগত পার
ছটফট ছটফট গরের নানি হাওলা ছাড়ি উডানত।
নানা চোখে ন পায় ঠাআর
কনঅ কিছু দেখা ন যার দেশ দুইন্ন্যাই আঁধার
হাতাই হাতাই রাইতর নিশিত কেএনে আইব এদ্দুর পথ। (কথা ও সুর: আবদুল গফুর হালী, শিল্পী:শেফালী ঘোষ )
শ্রমজীবী নারীর দৈনন্দিন জীবনের জীবনানুভুতির স্পর্শকাতর মর্মস্পশী বিষয়টি কথা ও সুরে বেজে যাচ্ছে ঘরে ঘরে,পাড়ায় পাড়ায়।সামাজিক চোখ রাঙানি, নানা প্রলোভন- ছলনা, নিপীড়ন নিরবে সহ্য করে নারী এগিয়েছে তার জীবন যুদ্ধে।
এ এক শ্রমজীবী নারীর নির্মম নিদারুণ জীবনাল্লেখ্য।
আসকার ডিঁইর পূকপারে আঁর
ভাঙাছোরা ঘর
হলইদ মরিচ মমসল্লা বাডি হোটেলর।
পাডা উ তার ঘডর ঘডর
সই গেইএ আঁর মন
অভাগিনীর লডর ফডর
বই যার গই জীবন
হাতর তাউল্লার হলইদ্যা রং
ন গরে লচ্ছর।
বঅস্তি আর হাঁনডিওয়ালায়
মিডা কথা কয়
ঠগা হাসি ভাইলদি চলি
আঁই তারাল্লয়
আঁর পিরিতি বাআই তরকারি
কড়কড়া ভাতর।
আছিল আঁর ঘরর মানুষ
আছিল বিয়াগগিন
মঅদি বাডি হাতত দিতাম
পাইল পরবদ্দিন
হেই সুখ ভাবি ন কাঁদি আর
দুখ বন্ধু আঁর কোঁয়ালর। (কথা ও সুর: সৈয়দ মহিউদ্দীন)
এ অঞ্চলের তালত ভাই তালত বোনের প্রেম-পীরিতের সম্পর্ক ইউরোপীয় রোমান্টিকতাকেও হার মানায়। এ এক পরম আত্মীয়তার সম্পর্ক-যুগে যুগে একে অন্যেকে কাছে যেমনটা টেনেছে,তেমনটা দূরেও সরিয়েও দিয়েছে। তবুও যেন 'শেষ হয়ে হইল না শেষ'।
ও পরানর তালত ভাই
চিডি দিলাম পত্র দিলাম
ন আইলা কিল্লাই
পরান্নান ক্যান গরের
তোঁয়ার মিডা মিডা কথারলাই।
শনিবার দিন আইবা বুলি
কথা দি গেইলা
শনি রবি পার হই গেল গই
আইজো ন আইলা
আইত ন পাইরলে আঁরে তুঁই
কথা দিলা কিয়র লাই।
তুঁই আইবা বুলি আঁই
পথর মিক্কা চাই
হারা দিন্নান পৈরর ঘাডত
তোয়াল্লাই কাডাই
ক্যানে তুঁই পঅরি রইলা
আঁর কথা মনত নাই।
তোঁয়ার লয় পিরিতির কথা
কেয়য় ন জানে
কনে দিব মনত শান্তি
তালত ভাই বিনে
কেএনে তোঁয়ার পেট ন পুইরলো
উগ্গা তালত ভইনর লাই। (কথা ও সুর : এম এন আখতার, শিল্পী: শেফালী ঘোষ )
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নারীর প্রতি বিধি নিষেধ, শারীরিক ও মানসিকভাবে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা কম হয়নি।এ যেন প্রতি পদে পদে নারীর জন্য পাতা ফাঁদ, অবরুদ্ধতার এ এক বাস্তবচিত্র মনশিক্ষামুলক এ গানটিতে বর্ণিত হয়েছে;
আউট্টা পার হইতে শাড়ি ছিঁড়িলি
ও ভইন কি গরলি
আউট্টা পার হইতে শাড়ি ছিঁড়িলি
মা বাপর মানা ঠেলি
ঘরর বাইর ক্যা হলি
তুই কি গরলি।
কঅন রসিকে দিল ঈশারা ন মানিলি ঘিরা বেড়া
দৌড় দিলি দুয়ার গান খুলি
কাঁদি কাডি ফিরি ক্যা আলি।
পানি আনতে পইর ঘাট
দেখালি তুই রূপের ঠাট
ন ভাবিলি কারে দেখালি
তুই অ ভইন কুলবালা
লইলি কলঙ্কর ডালা
ভালাবুরা চিন্তা ন গরিলি
শেষ কাডালে আছাড় ক্যা খালি
হায় হায় কি গরলি। (কথা ও সুর কবিয়াল রমেশ শীল)
শ্বশুর বাড়িতে জামাইয়ের আলাদা আদর যত্ন।জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে নানা আয়োজনে বাড়িতে তেলেসমাতি কান্ডকীর্তিতে মশগুল হয়ে পড়ে সকলে-
'ঘরত আইস্যে নয়া জামাই
হোরিয়ে পিডা বানার নয়া জামাইল্লাই
জামাই তো পঅল হই গেইয়ে
তালর খুশবো পাই।
নয়া বউ আস্তে আস্তে পানর বাট্টা লই
ছোড ছোড খিলি বানার দুলার ঢাগত বই
নয়া জামাই নাক টানের তালর পিডার খুশবো পাই।' (কথা ও সুর: মোহাম্মদ নাসির)
জীবন পরিক্রমায় অতীত শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলি নাড়া দেয় হৃদয়ের গোপন প্রসূণে। একের পর এক সেলুলয়েড ফিতার মতো ভেসে ভেসে ওঠে মনের আয়নায়। কিন্তু যেইদিনগুলো চলে গেছে, তাকে কি আর কখনও ফিরে আনা যাবে?
সোনা চান্দি টেঁয়া পইসার নইরে কাঙ্গাল
তোরা আঁরে ফিরাই দে রে আঁর ছোড কাল।
পদ্ম পইরর বটতলে বউভাতি খেলা
পাতার বাঁশি ঝড়র পানি সূর্য খোলার মেলা
নানার বাড়ি খালির বাড়ি আম জাম তাল।
কাগজ দি বানাইতাম নৌকা বইর পাতা ছিঁড়ি
ভাইয়ে ভইনে নতুন জামা কইত্যাম কাড়াকাড়ি
মাইজ্যার পছন্দ হলদ্যা রং আঁর পছন্দ লাল।
নামতা অংক শিখাইত লাল মিয়া মাষ্টার
মাদার বিচি গণি কইত দুইএ দুইএ চাইর
দাদার কিস্তা চাঁদর বুড়ি বাঁশ ঝাড়র ছিয়াল।(কথা ও সুর: আবদুল গফুর হালী)
আত্মতত্বের অনুসন্ধানী মন সৃষ্টিতত্বের নিগূঢ় রহস্য উম্মোচনে ব্যাকুল হয়ে ঘুরে ফিরেছে এই বিশ্ব চরাচরে।কেন জন্ম,কেন মৃত্যু! দেহ কি,আত্মা কি! কেন একদিন মাতৃজঠরে মাতৃকোষ পিতৃকোষ মিলিত হয়ে ভ্রূণাবস্থা থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিবর্ধিত হয়ে মানব শিশুর জন্ম! কেনই বা আবার মৃত্যু পরবর্তী এই পচনশীল মানবদেহ অনু-পরমানুতে বিভাজিত হয়ে খসে খসে পড়ছে। কি টোনায়,কি সে আকর্ষণ-বিকর্ষণে! এ গানে তারই উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন পন্ডিত মহাশয়।
কি জ্বালা দি গেলা মোরে
কি দুঃখ দি গেলা মোরে
নয়নের কাজল পরানের বন্ধু রে
ন দেখিলে পরান পোড়ে।
না রাখি মাটিতে না রাখি পাটিতে
না রাখি পালংকের উপরে
শিরের সিন্দুরে রাখিতাম বন্ধু রে বেড়িয়া রেশমি ডোরে।
বন্ধু পরবাসী পরের ঘরে আসি
এত ঘুমে কেএনে ধরে
কোকিলা করে ধ্বনি পোহাইল রজনী না ডাকি ননদির ডরে।
নারীর প্রেম গাছে কি টোনা কইরাছে
বস্ত্র খসি খসি পড়ে
কহে আসকর আলী সাধু শত জনে
বৈরাগী বানাইল মোরে।( কথা ও সুর: আসকর আলী পন্ডিত)
জীবন বাস্তবতা ও সমাজ বাস্তবতার নিরিখে জন্ম-মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে ভাবুক মনে যুক্তি তর্কের কোন শেষ নেই। দুইদিনের এই পৃথিবীতে তুমি কার, কে বা তোমার! এ গানে তারই কথা বিবৃত হয়েছে।
আইচ্ছা পাগল মন রে
দিন গেলে গই ঘাডত বই বই কাঁদিবি
(ও পাগল মন রে)
আজরাইলে দিব ডাক
শোয়ার হইব সিনাপাক
কডে পাইয়ম ভাইপুত ভাইঝি
কডে পাইয়ম মা বাপরে।
এগানা বেগানা আইব
চাইর কিনারদি বই কাঁদিব
মা কাঁদিব পুত পুত গরি
হউসের দুনিয়া রে।
চাইর জনে চাইর কোনাত ধরি
আঁরে নিব কাঁধত গরি
বড় দীঘির পাড়ত লই যাই
রাখিব শোয়াই রে।(কথা ও সুর: প্রচলিত)
হঁওলা গান চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান।গীত,নৃত্য ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে এ গান পরিবেশন করা হয়। নানা ধরনের উপমা,উৎপ্রেক্ষার রসময় শব্দের গাঁথুনিতে অসাধারণ চিত্রকল্পের এ গান এ অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহ্যকে ধারণ করে আছে। মলকা বানুর হঁওলা, পরীবানুর হঁওলা উল্লেখ্য।
মালকাবানুর দেশে রে, বিয়ার বাদ্য আহা বাজেরে
কেমতে যাইব মনু মালকাবানুরদেশে রে।
মালকাবানুর সাত ভাই, অভাগ্যা মনুমিয়ার কেহ নাই----
এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত অসংখ্য গান এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে, মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সীমিত কলেবরে তুলে ধরা তেমন একটা সহজ নয়,ব্যাপক এর পরিসর। তবুও চুম্বক অংশটুকু তুলে আনার চেষ্টা করছি মাত্র। অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী, গীতিকার, সুরকার,সংগ্রাহক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রচার ও প্রসারে জীবনভর নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন।এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনানুভুতিকে যারা কথা, সুর ও কন্ঠে ধারন করেছিলেন তাদের মধ্যে আসকর আলী পন্ডিত, খাইরুজ্জামান পন্ডিত, কবিয়াল রমেশ শীল, কবিয়াল ফনী বড়ুয়া,কবিয়াল ইয়াকুব আলী, মলয়ঘোষ দস্তিদার,মোহাম্মদ নাসির, মোহনলাল দাশ,আবদুল গফুর হালী, এম এ রশিদ কাওয়াল,এম এন আখতার,শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ,সৈয়দ মহিউদ্দিন,আহম্মদ কবির আজাদ,কল্পনা লালা,সনজিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, নুরুল আলম,ইকবাল হায়দার,বুলবুল আক্তার,আমান উল্লাহ গায়েন,অজিত বরণ শর্মা, সিরাজুল ইসলাম আজাদসহ প্রমুখ সকলের কর্ম ও কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
মানব-সমাজের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে,তাই মানব- সংস্কৃতিরও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে।সমাজের বিবর্তন, পরিবর্তন,রূপান্তর আছে, মৃত্যু নেই।প্রয়োজনের তাড়নাতেই আবার ব্যক্তিমন তার সংযোগ খুঁজে নেয়; সংস্কৃতির রুদ্ধগতি মজা নদীতে আবার ধারাবাহিকতার স্রোত বইতে থাকে। এ স্রোত আগের চেয়ে বেগবান ও গভীর।বিবর্তনের চরম স্তর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে নদী রূপান্তরিত হয় সমুদ্রে।পরিবর্তন আসে পরিমাণে ও গুণেও। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের এ প্রবহমানতা ঠিক এভাবেই গিয়ে মিশুক মহাগণজীবনের মহান সংগীতে।
Post a Comment