লিপি নাসরিন
আশ্চর্য মানস-চারণা
লিপি নাসরিন
গ্রন্থঃ গৌরাঙ্গ মোহান্তের পদ্মরাইজোম ও আনথিয়ার পুষ্পাধার
কবিতা কখনো হয়তো দর্শন হয়ে ওঠে আবার কখনো তা নিছক আলঙ্কারিক কাব্য হয়েই বেঁচে থাকে কিন্তু কবিকে আমি অবশ্যই দার্শনিক বলে চিহ্নিত করি। কবিকে হতে হয় জ্ঞানী এবং ধ্যানী, সেক্ষেত্রে দার্শনিকের অন্তর্দৃষ্টি, বিচারের নিরপেক্ষতা কি কবির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? কবি তো এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে অন্য এক জগতে আত্মনিবিষ্ট থাকেন; তবে কবিতায় দর্শনের চতুরন্ত পেরিয়ে সৌন্দর্যের সৌরকিরণ দৃপ্ত হয়ে ওঠে। সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত কথা—কবিরা জ্ঞান দিয়ে কবিতা লেখেন না , লেখেন সৃজনীশক্তি ও অনুপ্রেরণা থেকে, তবে কবি অবশ্যই অর্ধ-উন্মাদ বা মাতাল নন, সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রয়াস তাঁকে সমাজসচেতনও করে তোলে। একটা নীতিহীন গলিত সমাজে সৌন্দর্য কোন দ্যুতি ছড়াতে পারে না বলে কবির অস্থির মানসপট থেকে আবেগের যে স্ফুরণ ঘটে তার ভাষিক উদ্ভাস কবিতা। এই বইয়ের কবিতাগুলো পাঠে বিচিত্র সব শব্দের প্রতীকী ও আলঙ্কারিক ব্যবহার সে বার্তা আমাদের নিউরনকে দ্যোতমান রাখে। 'জন্ম -ক্ষুধা-বেদনা-ব্যধি-মৃত্যু নিয়ে বৃক্ষ মূলত নির্বেগ মানব', ' আঘাতের প্রবলতা মুছে ফেলতে পারে শ্বাসত্রিভূজের সরলরেখা'— এ লাইন দুটি 'বৃক্ষ' কবিতার। পারিপার্শ্বিক বিরুদ্ধ অভিঘাত কবিকে বিষণ্ণ করে তোলে, তাইতো কবি আশ্রয় খোঁজেন পর্তুলাকা রঙের ভেতর কিংবা পরিচিত মৃত্তিকায়।
কবিকে যদি বলা হয় তাঁর কোনো কবিতার ব্যবচ্ছেদ করতে সেটি তিনি নিজেও পারবেন না কিন্তু যে বিশেষ অবস্থা তাঁকে জারিত করেছিল হাতুড়ি পিটিয়ে শব্দের পাটাতনে আবেগকে রূপায়িত করতে সে বিষয়ে তিনি পূর্ণ অবহিত।'তর্জনীর জ্যোতির্বলয়' থেকে 'শহরে উল্কামুখ'—প্রতিটি কবিতা কবির আবেগের প্রতীকী সঞ্চয়ন। সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা মর্মে টানে তা হলো তীক্ষ্মফলার মতো সব শব্দকে টেনে এনে কবিতায় থিতু করানো। আগেও এবং এখনো পড়তে গিয়ে আমি শব্দগুলোকে ভাঙতে চাই, উড়িয়ে দিতে চাই কিন্তু ওরা কেবল স্থির বসে থাকে তীক্ষ্ম ফলা আমার দিকে তাক করে আর চমৎকার ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে আমাকে বিস্ময়বিহ্বল করে, আমাকে প্রেরণা জোগায় নতুন কিছু সৃষ্টির। আমার কাছে কবিতার গাণিতিক বিন্যাসের চেয়ে চিত্রময়তা অনেক বেশি অভিযাচিত, কারণ তা আমাকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। সত্যি করে যদি বলি তাহলে এ বইয়ের প্রতিটি কবিতা আঙ্গিকে অনন্য। এ সকল কবিতা পাঠে পাঠক কেবল যে সৌন্দর্যের অমৃতরসে সিক্ত হবেন তা নয়, পাঠক জানতে পারবেন অনেক বিখ্যাত স্থাপনার নাম যা তাকে কৌতূহলী করে তুলবে। সত্যিই আমি জানি না স্ট্যাটন দ্বীপ কোথায়, আর কোথায় বা ভেরাজানো ব্রিজ কিংবা প্রান্তকাসলের ইতিহাস কী, কোথায় সেই ঐতিহাসিক অ্যাঙ্কর ওয়াট—এমনি কতো ডোমেনে কবি নৈঃশব্দ্যের শূন্যতায় হেঁটে বেড়িয়েছেন আর গ্রিক প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির নামে উড়িয়ে দিয়েছেন কুড়ি জোড়া কণ্ঠি-ঘুঘু। 'চৈত্রসংক্রান্তি' কবিতায় কবি নস্টালজিক হয়েছেন সিন্দুরমতি মেলার তরমুজ, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই, তিলেখাজা, কদমা আর জিলাপির সাথে কিশোর-কিশোরীর সবুজ মৌরির গন্ধে, আর আশ্চর্য সে সুরভি আমাকে মোহিত করে—ইছামতির বালুচরে আমার ফেলে রাখা স্মৃতিময় সেই মাটির ঘরের ছোট্ট উঠোনটিতে জেগে থাকা রহস্যময় মৌরি ফুলে বেড়ে ওঠা মৌরি যা ছিঁড়ে নিয়ে আমি আকণ্ঠ সুগন্ধি চিবোতে থাকি। 'রাত্রির পরজবাহার' কবিতায় রাত্রির গভীরতার সাথে উদ্দামতা থিতিয়ে এলে কল্পনার অপ্সরাগণ বিদায়কালে পুরুষের রক্তে কী করে রোপণ করে পরজবাহার রাগের কিন্নরি-ধ্বনি তা কবি উন্মোচন করেন। চারপাশের যে দৃশ্যমান জগৎ তার হুবুহু বর্ণনা কবিতা নয়, যে জগতের জঠর থেকে কল্পনার কম্পন উঠে আসে তার সৌন্দর্যময় সীবনশিল্পই কবিতা। এ কাব্যসংকলনের অনেকগুলো কবিতায় 'পদ্ম'(ফুল) শব্দটির বহুল এবং বর্ণিল ব্যবহার লক্ষণীয়। পদ্মদৃশ্য, পদ্মতরঙ্গ, পদ্মগন্ধী,পদ্মরেণু,পদ্ম-অসীমতা, পদ্ম-অতলতা, পদ্মচোখ প্রভৃতি শব্দের সাথে কবি যোগ করেছেন অদৃশ্য পদ্মবন। কবির মনোজগতে পদ্ম-প্লবতার সাথে পদ্মের অনন্ত রূপবাহার বিচ্ছুরিত হয়েছিলো কোন এক নিঃশব্দ নক্ষত্রের রাতে! 'নদী হয়ে ওঠো' কবিতায় লিখেছেন, 'মুঠো ঘাসের ভেতর টলস্টয়ের করোটি-কিরণ নির্বাক হয়ে এলে তুমি নদী হয়ে ওঠো' কিংবা ' ছৈলাবনের মধুমায়া বাতাসের পুংকেশরকে ডেকে নেবার পর সন্ধ্যা এলো'( ছৈলাবনের মধুমায়া) —ঠিক এ মুহূর্তে লিখতে গিয়ে আমি ভাবছি সত্যিই তো দূর দিগন্তে কোনো মধুমায়া সন্ধ্যা নেমে এলে জলকন্যা জাগিয়ে রাখে অড়হড় ফুলের কাঁপন। পড়তে পড়তে আমি সেই ছৈলাবনের মৃদু তরঙ্গের সঙ্গীত শুনি মুগ্ধতার আবেশে। 'ঝরনার তৃষ্ণায় কাঁপে কামটঙ্গি' অথবা 'তরঙ্গ-উষ্ণতার খোঁজে ছুটে আসা সিগালের নাকে লেগে থাকে মাছের গন্ধ'—এরকম অসংখ্য প্রাণোমোদিত চিত্রকল্পের জগৎ পাঠকের চোখে রঙিন সুরমা লাগিয়ে দেয়। বাস্তবের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের হাইপোথেসিসে বিষণ্ণ আমরা যে জগতের দেখা কখনো পাই না তা ধরা দেয় কবির বাক্যাশ্রিত সংবেদনায়। যে অতিমন্দ্রিত সাঙ্গীতিক স্বর জিথারের শরীরে আঙুল ছোঁয়ালেই ঝরে পড়ে, তা যেন মৎসকুমারীর গানে ব্যঞ্জিত সবুজ কবিতাতরঙ্গ।
'সুবর্ণ বৃষ্টিপাতের আগে অনুধাবন করি উত্তেজনার উদ্বৃত্তি আনন্দকে হ্রস্বতর করে(শ্রীপর্ণের স্পন্দন)'। এ প্রকাশের সাথে 'সকল আনন্দ একটি আঘাতে ভূপাতিত; মৃত্যু জন্মের সাথে ঐকতানিক' (জঁ-মিশেল মোলপোয়া) সাযুজ্যপূর্ণ—দুজন কবির প্রায় একই উপলব্ধি দুটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয়ে উপস্থাপিত হয়েছে সমসাময়িক কালে। 'সোনালু ফুল' কবিতায় স্মৃতি-উদ্ভাসিতা এক বালিকা যার শরীরে সোনালু ফুলের সৌরভ অনুরঞ্জিত, কবির মগ্ন চেতনায় ছড়িয়ে রেখেছে সৌগন্ধ্য, হয়তো তা কবির পরিণত হৃদয়ে ক্ষীণ বেদনা জাগিয়ে রাখে কিন্তু 'অকেজো কর্টেক্স' কবিতায় এক স্বপ্নরাজ্যবাসিনী কবিকে যখন জিজ্ঞেস করে,'গৌরাঙ্গ কেমন আছেন?'—আমরা স্তম্ভিত হয়ে হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার কাছে প্রত্যাবর্তনের কৌশল খুঁজি। তবু যে পথ গিয়েছে দূরে সূত্রবিহীন, তার কাছে কি ফেরা যায়? মায়াতরুণী তুমি কোথাকার কোন 'বনলতা সেন' হয়ে কবিকে মায়াদর্পণে ভুলিয়ে গেলে?
শব্দের বহুমাত্রিক রূপ, প্রতীকতা আর শব্দচিত্রের নান্দনিকতা উত্তরাধুনিক কবিতার অন্যতম কৃৎকৌশল। ভেতরের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, সে আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি অন্বেষণে লীলাময় আচরণ আর বহুঅনুভব নিয়ে জীবনের যে প্রপঞ্চ তাকে শব্দের মধ্যে মূর্ত করে তোলাই কবিতা বিনির্মাণের উদ্দিষ্ট। এ বইয়ের কবিতাগুলো জীবনের সেই অপ্রত্যক্ষ, রূপান্তরিত, আলোড়িত, প্রতিস্থাপিত জগৎকে উন্মোচিত করে।
'পৃথিবীর সমাজে সজ্জিত থাকে এক মিথ্যা রংধনু, বিবর্ণ হলেই মানুষ রঙের প্রলেপ চাপায়'—'শেফালিস্রোত' কবিতায় কবি আবারো উচ্চারণ করেন এক দৃঢ় সত্য যা চিত্রকল্পের থরে থরে সাজানো এক মূর্তকল্প থেকে বেরিয়ে আসা অবিনাশী স্রোত, কেবল বয়ে চলে পিছু না ফিরে।
'বেঁচে থাকার অন্ধকার' কবিতায় কবি বিষণ্ণ হৃদয়ে অন্ধকারের পাশেই গড়ে তোলেন লেকসজল অরণ্যভূমি আর 'তোমার কাছে যেতে' এবং 'জোনস বিচ ও নিশ্বাসরেখা' কবিতায় এক ক্লান্ত প্রেমিকের হৃদয়ের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে মধুরতর ধ্বনিগুচ্ছে। 'তোমার কাছে যেতে উড়তে হয় অনেক দূর', তেমনি 'যে পথে তোমার নিশ্বাস ছড়ানো সে পথ আমাকে চিনিয়ে দাও।'
জীবনানন্দ হেঁটেছিলেন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে 'সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে' অনেক ঘুরেছিলেন 'বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে'—আর পদ্মরাইজোম ও আনথিয়ার পুষ্পাধারের কবি জোনস বিচ থেকে আকাশের খণ্ডিত রাজতন্ত্রে, মৃৎস্তরবিহীন মরুর অগ্নিদহন থেকে দিগন্তলীন দিবসে, শরীরের কলাবৃত্ত থেকে ওকাম্পোর প্লাতাতীরে, পার্কের বেঞ্চ থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সবুজ লনে, পৃথ্বী থিয়েটার থেকে কস্তুরীর উন্মাদী কণায়, আন্দামানের তীর থেকে আটলান্টিকে, জুহু সৈকত থেকে স্ট্যাটন দ্বীপে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেরেন অদ্ভুত পালক আর হরিণ লোমের উত্তাপ কিন্তু, আকাশের পথে কৃষ্ণচূড়া জন্মাতে পারে না বলে তাকে প্রলম্বিত শান্তি দিতে পারেনি সেই সোনালু রঙ মেখে খেলতে আসা বালিকা অথবা পদ্মসুরভিত অপ্সরী; তাই তো কবি সমাকুল কণ্ঠে বলেন, 'তোমার পালকে মিশিয়ে রেখো গুলমোহরের রং'— না আমি কোন তুলনামূলক আলোচনায় বসিনি; যে পালক তিনি ভাসিয়ে দিয়েছেন সহজিয়া সুরে প্রেম আর অভিমানের ক্লান্তিহীন প্লবতায়, পদ্মতরঙ্গের ইন্দ্রচাপে, আমি শুধু তার রাইজোমের(ভূনিম্নস্থ রূপান্তরিত কাণ্ড) সুপ্তবাসনার কাছে কিছুটা হলেও সঁপে দিয়েছি নিজেকে, বাকিটুকু না হয় পাঠকের হৃদয়ে তোলা থাক।
কবি ও কবিতার জন্য শুভ কামনা।
Post a Comment