DEHLIJ

শাহানা আকতার মহুয়া

গুচ্ছ কবিতা

শাহানা আকতার মহুয়া



ইউটোপিয়া


কপালে আরো দুঃখ আছে, এখনো এতো স্বপ্নের রং! এখনো চিড়বিড় ফোটে রূপশালি কবিতার খই, হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে ছটফটে ইচ্ছের মায়াবী ফানুস। চুপিসারে, কিভাবে যেন বাসা বেঁধেছে এক অজানা অসুখ। সুখের উষ্ণতায় নিজেকে সেঁকে সকলেই যখন বাড়াতে চায় তুলতুলে পালঙ্কের শোভা-অযথাই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আমার যতসব উপাখ্যান তৈরির প্রবণতা। অযথাই চূড়ান্ত অভিমানে নিজেকে ভেঙে ভেঙে হাড়ে-মজ্জায় বেদনার মালা গাঁথা। প্রব্রজ্যা ইচ্ছেরা এতো যে দুর্বিনীত হয়, এমনি পাগলাটে আর একগুঁয়ে যে সকল বিঘ্নের মুখে চুনকালি লেপে ত্বরিত এগিয়ে যাই অগম্যতার দিকে। আর তাতেই খুলে যায় একেকটি ঝলমলে বর্ণিল মুখোশ! ক্ষমাহীন স্বজনেরা হয়ে ওঠে নৃশংস মৌমাছিদল। আমার সমস্ত শরীরে বিঁধে যায় সহস্র ভ্রুকুটির হিংস্র হুল। চোখে চোখে উড়ে আসে নগ্নতার বিচিত্র চালচিত্র।... রাতজাগা চোখে এক আকাশ শূন্যতা নিয়ে আমি তবু স্বপ্ন দেখি। চিরন্তন প্রথার মতো সোনার শিকল বাজে আর আমি ভয়ানক অসুখে ভুগি... অপ্রতিরোধ্য স্বপ্ন দেখার অসুখ। জিউসের সোনালি ঈগল এসে যেভাবে ফালাফালা করেছে প্রমিথিউসের নির্ভীক বুক- তেমনি অপলাপের বজ্রে ছিঁড়ে যায় আমার সমস্ত আকাঙ্ক্ষার সূত্র। নির্লজ্জ ভিক্ষুকের মতো তবুও স্বপ্নের দরোজায় হাত পেতে থাকি। প্রত্নপিপাসায় জ্বলজ্বল করে অকরুণ আগুনের দেশ। যেতে হবে অনেক দূরে, বহুদূরে ইউটোপিয়া- সেখানে নাকি স্বপ্নেরা অনিঃশেষ!



হাওয়া রমণীরা


খুলে ফেলে তারা অবদমনের ঘের

অযথা প্রলাপে নিজেকে জাগায় ফের।

এই যে এখানে ছায়া-রমণীরা নাচে

হাওয়ায় দোলা হৃৎকমলের ভাঁজে।



এইতো এখানে অগ্নিঝরানো রাতে

রমণীরা কাঁদে, কাঁদে বাতাসের সাথে

বেদনার জলে ডুব দিয়ে বিভাবতি

ছড়িয়েছে যেন অকরুণ মায়াজ্যোতি।



কিছুই গোপন থাকে না তাদের কাছে

নগ্ন ছায়ারা করতালি দিয়ে নাচে।

হাওয়া নারীরা তবু কেন পুড়ে মরে 

নিজেদের দেখে লাশকাটা কোনো ঘরে।




মুখোমুখি শেষ বিকেলে


মুখোমুখি বসে থাকা চাতক বিকেলে

ডানা মেলে উড়ে যায় ঝাঁকবাধা রোদ—

বোঝেনি কেউ কখন যে থেমে গেছে

বন আর বিথিকার গান,

কিছুদূরে, লেকের ধারে মৎস্য-উপাসনায় বসে থাকা লোকটি

হঠাৎ নিজের একটা চোখ তুলে বড়শিতে গেঁথে

বেমালুম ছুঁড়ে দিল মাছের আধারের মতো!



এইসব দেখতে দেখতে দৌড় দেয় সময়ের খরগোশ

পুঁতির মতো ঘনলাল চোখদু’টো তুলে চারপাশ দেখে নিয়ে

টুক করে ঢুকে যায় ফের ঘাসের বুনোটে ঘেরা নিঝুম গুহায়।



খুব ছোট আর ভাঙা ভাঙা কথার জবাব,

কপালের লালটিপ, গালের একফোঁটা টোল,

আধুনিক কবিতার আড়াল কিংবা নির্লজ্জ উদ্ভাস

এইসব খুঁটিনাটি বিষয়ের অপ্রয়োজনীয়

কথার সাথে সাথে ফুরিয়ে আসে বিকেলে আয়ু।

গোধূলিটা বড় বেশি উজ্জ্বল আর মায়াময়,

আকাশের গায়ে রঙগুলো লেগে আছে ফাগুয়ার মতো

যেন আলতো ছোঁয়ায় তুলে নেয়া যাবে

বহতা নদীর মতো গোধূলির রঙ।



মুখোমুখি বসে থাকা এইসব উজ্জ্বল বিকেল কিংবা

লাবণ্যময় গোধূলিবেলারা খুব স্বল্পায়ু হয়।




জলদস্যুর মতো অন্ধকার...


রাত্রির চরকায় সারারাত অন্ধকার বুনি।

বহুদূরে রূপসী পদ্মার খোলে খলবল করে

চপলা মৎস্যকুমারীর দল।

ভালবেসে বোকা কন্যা

গলে গলে সমুদ্রের বুদ্বুদ হয়!



ছেঁড়া জাল, তন্তুতে তন্তুতে

হামাগুড়ি দেয়া অস্থির অন্ধকারে



কৃষ্ণ সমুদ্রে এক অযাচারী জেলে

একাকী বসেই থাকে ছেঁড়া জাল হাতে

আতীব্র বাসনা তার-

অতল অন্ধকার থেকে

ছেঁকে ছেঁকে তুলবে সে

জলকাব্যরাশি।




থাকা, না থাকা


আমাদের আর কিছু নেই শুধুমাত্র আমরা ছাড়া। এই লোকালয়, বুনোপথ কোমলগন্ধী জীবনের মৃদু ঘ্রাণ, আকাশের সামিয়ানা ফুটো করে দু’এক কণা শিশিরের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়া খুব বেশি কিছু নেই আমাদের।

টুকরো টুকরো বাসন্তী ভাললাগা, খঞ্জনার চাপল্যের মতো খুনসুটি আর সবকিছু ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ম্যানগ্রোভ-আশা...

আমাদের মাঝে অনেক সুর আর ছন্দ- এবং অনেক কণ্ঠের উপস্থিতি ছাড়া অন্য কিছু নেই।



No comments

FACEBOOK COMMENT