DEHLIJ

রফিকুর রশীদ

সমুখে শান্তিপারাবার 

র ফি কু র র শী দ




কে জানত যে বিয়ে হবার পর বছর খানেক না পেরোতেই রানী এমন কঠিন অসুখে পড়বে! কঠিন অসুখ বই কি ! ডাক্তার-কবরেজ ঠিকমতো ধরতেই পারে না --- অসুখটা কী। কাশতে কাশতে শুকনো কফের সঙ্গে একদিন সামান্য লাল আভা দেখে বুড়ো কবরেজ চিন্তিত মুখে জানালেন, লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না। এ যে দেখছি গলক্ষত!
 
পরিবারের সকলেই চিন্তিত।

রানীর স্বামী সত্যেন্দ্রনাথও ডাক্তার। অ্যালোপ্যাথির এলএমএফ পাস। এ সময়ে তার একটা পরামর্শ পেলেও সবার জন্যে স্বস্তির হতো। কিন্তু তাকে কি হাতের কাছে পাবার জো আছে! সে আছে সুদূর আমেরিকায়। হোমিওপ্যাথির উঁচু ডিগ্রি করছে। এই তো ক'মাস আগে মৃত্যুপথযাত্রী শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে দেশে এসে বেড়িয়ে গেল। আবার এত ঘনঘন দেশে আসা যায়! হ্যাঁ, তখন রানীর অসুখ ছিল না। বরং চোখেমুখে ছিল অচেনা শিহরণ, অজানা সুখউচ্ছ্বাস। সে উচ্ছ্বাস কী করে যে ব্যক্ত করতে হয় আর কী করে যে ঢাকতে হয়, সেই ছলাকলার কিছুই জানে না সে। জানবে কী করে--- সেই সুযোগ পেলে তো! ওদের শৈশব কেটেছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে, কিন্তু কড়া শাসনে। আবার গত তিন বছর একটানা কাটিয়েছে শিলাইদহের মতো নিভৃত পল্লীতে। কার কাছে জানবে, আর কী শিখবে! বয়সই বা কত রানীর! বড় জোর বারো কি সাড়ে বারো!

শিলাইদহ থেকে সংসার গুটিয়ে আনার প্রধান কারণ হচ্ছে, সেখানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ নেই। ঘরোয়া স্কুলে এসে ইংরেজি শেখায় লরেন্স সাহেব, গণিত শেখায় জগানন্দ রায়। কিন্তু রথীর সামনে যে এন্ট্রান্স! সিদ্ধান্ত হয়, লেখাপড়ার স্বার্থেই সবাই বাস করবেন শান্তিনিকেতনে। বসবাসের মতো যথেষ্ট ঘরদোর সেখানে নেই। সেই ঘরদোর তৈরি করিয়ে নিতে যেটুকু সময় লাগে, সেই সময়টুকু কাটানো হবে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে। কলকাতায় পা রাখার পরই মৃণালিনী গোঁ ধরলেন, মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে।
মেয়েদের মানে!
রবীন্দ্রনাথ চমকে ওঠেন, কী বলছ তুমি! একবারেই তিন কন্যাদান?
আমি কি তাই বলেছি নাকি?
ওই যে বললে মেয়েদের....
হ্যাঁ, একে একে সব মেয়েরই তো বিয়ে দিতে হবে।
কালো চুলদাড়ির ফাঁকে রবীন্দ্রনাথের গৌরবর্ণ চেহারা উজ্জ্বল আলোয় হেসে ওঠে। হাসির গমকে নেচে ওঠে ভাঁজভাঙা বাবরি চুল। হাসতে হাসতেই বলেন,
তাই বলো। একে একে। শোনো, বেলার বিয়ে তো একরকম ঠিক হয়েই আছে। এখন আমি হ্যাঁ বললেই হয়ে যায়।
তুমি শরতের কথা বলছ?
হ্যাঁ, ওর বাবার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে সেই কবে!
হুঁ, কবিদের কথা!
রবীন্দ্রনাথ রুষ্ট হন, একটু স্বর চড়িয়ে বলেন,
কেন, কবিদের কথার দাম নেই বুঝি! জানো শরতের বাবা বিহারীলাল চক্রবর্তী আমারও গুরু। তাঁর কথার দাম নেই?
মৃণালিনী দেবী সহসা কথার গতিমুখ ঘুরিয়ে দেন,
না, আমি বলছিলাম --- শরতের বয়সটা বেলার তুলনায় বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
বয়সটাই দেখলে, যোগ্যতাটা দেখলে না? এমএ,বিএল। মুজঃফরপুরে তার ভালো প্র্যাকটিস।
কোথায় মুজঃফরপুর!
বিয়ের পর বেলাকে তো সেই মুজঃফরপুরেই নিয়ে যাবে।
হ্যাঁ,তাই তো যাবে। মুজঃফরপুর তো আর ভারতবর্ষের বাইরে নয়! চিন্তা কিসের?
বাইরে আষাঢ়ের আকাশ ছিল ঘন মেঘে ছাওয়া। বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে সহসা। তারপর বৃষ্টি নামে ঝাঁপিয়ে। জানালার খড়খড়ি নামিয়ে এসে মৃণালিনী দেবী জোর দাবি জানায়,
আমি কিন্তু মেজো মেয়েরও বিয়ে দিতে চাই, হুঁ।
রানীর বিয়ে! ওর বয়স কত বলো দেখি!
ওই বয়সেই আমার বিয়ে হয়েছে। আমি সংসার করিনি? মেয়েদের তালগাছ বানিয়ে কী লাভ?
রবীন্দ্রনাথ রাগ করেন না। মৃণালিনী দেবী আগের মেজাজেই বলে যায়,
রানীর পরে মীরা আছে, সেটাও তো ভাবতে হবে!
হ্যাঁ,তুমি একদিনেই সব ভাবনা ভাবতে চাইছ, এই তো!
সে তুমি যাই বলো,আমি কিন্তু রানীর বিয়েও দিতে চাই। পাত্র দেখ।
রবীন্দ্রনাথ কেবল সুবোধ বালকের মতো ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানান,আচ্ছা।

বাস্তবে হলোও তাই। আষাঢ়-শ্রাবণ পর পর দুই মাসে দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে মানেই ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার। রাজ্যের খরচ-খরচা। যৌতুক বিরোধী বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া কিংবা দু'চার পাতার গল্প ফাঁদা যতো সোজা, বাঙালি ঘরের মেয়ে বিদায় করা অতো সোজা নয়। আকারে প্রকারে পনের টাকা গুণতেই হয় সব বাবাকে। সব দিক গুছিয়ে উঠতে উঠতে রবীন্দ্রনাথ খানিকটা ক্লান্ত। এ দিকে মৃণালিনী দেবী মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরে খুব নিশ্চিন্ত হয়েছেন। বড় জামাই কোর্টের উকিল, থাকে মুজঃফরপুরে। বেলাকে নিয়ে সেইখানে ঘরসংসার পেতেছে। বিয়ের পরও রানী আছে মা-বাবার সঙ্গে। তার বয়স অল্প। মেজো জামাইকে পাঠানো হয়েছে হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রি আনতে, আমেরিকায়। সে ফিরলে তখন সংসার পাতা হবে।

দুই মেয়ের বিয়ের হই চই শান্ত হলে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। ইচ্ছে --- এখানেই বাস করবেন এবং মনের মতো একটা স্কুল খুলবেন। আবাসিক স্কুল। বসবাসের জন্যে খড়ের চাল ছাওয়া একটা বাড়ির পত্তনও হলো।' নতুন বাড়ি' সেটার নাম। কিন্তু এই নতুন বাড়ি নতুন সংসারে মৃণালিনী দেবীর শরীর টিকতে চাইল না। কী যে অসুখ বুঝাও যায় না, আবার স্বস্তিও হয় না কিছুতেই। ভালো লাগে না কিছুই। এত যে আদরের ছোট ছেলে শমী, তার কথারও জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। শমী কিছু না বুঝেই জিজ্ঞেস করে, তোমার কি বড়দির কথা মনে পড়ছে মা?

মা কথা বলে না। মীরা এসে মায়ের কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রেখে জানতে চায়, তোমার কী হয়েছে মা?
মৃণালিনী দেবীর কণ্ঠে কোনো স্বর স্ফুট হয় না। কেবল চোখ ফেটে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নীরবে। আঁচলে মুখ ঢেকে মৃণালিনী সেটুকুও আড়াল করতে তৎপর হন। মায়ের চোখে জল দেখে শমীও একবার ফুঁপিয়ে ওঠে, তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে। সবাই জানে, বড় ছেলে রথীর চেয়ে শমী একটু আলাদা স্বভাবের মানুষ। এ রকম ব্যতিক্রমী ছেলেমেয়েদের আয়ু নাকি খুবই স্বল্প হয়। তা নিয়েও মায়ের খুব চিন্তা। শমীর মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকেন, ওর চোখের গভীরে চোখ রেখে কী যেন দুর্বোধ্য পাঠ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হন। তারপর কনিষ্ঠ পুত্রকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদরে ভরিয়ে দেন সারা মুখ।শমী কোনো রকমে মাথাটা বের করেই বলে, বাবাকে ডাকব মা?
রবীন্দ্রনাথ নিজেও খুব চিন্তিত স্ত্রীর স্বাস্থ্য নিয়ে।

ব্যক্তিগত দুঃখ শোক কি দুশ্চিন্তা কখনো তাঁর কর্তব্যকর্মের পথ আগলে দাঁড়াতে পারে না। এই শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ অনেক কাজের পরিকল্পনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি সেই কর্মপ্রবাহেই ডুবে থাকতে চান। কিন্তু মানবিক সুতোয় যখন টান পড়ে, তখন কে পারে সেই আহ্বান উপেক্ষা করতে? অসুস্থ স্ত্রীর উপযুক্ত চিকিৎসার জন্যেই শান্তিনিকেতনের পাট গুটিয়ে রবীন্দ্রনাথ সবাইকে নিয়ে আবার এলেন কলকাতায়। ডাক্তার-কবরেজের চিকিৎসা চলল মাসের পর মাস। উন্নতির লক্ষণ বিশেষ নজরে পড়ে না। একদিন একটু ভালো কাটে তো সাতদিন কাটে অতি কষ্টে। ভাদ্র মাস পেরিয়ে গেছে সেই কবে। আশ্বিনের শেষাশেষিতেও মৃণালিনী দেবী ছটফট করে ওঠেন --- ভাদুরে গরমটা যাবে না দেখছি। উহ, কী অসহ্য!
এরই মাঝে কার্তিকের কুয়াশাঘেরা এক রাতে মৃণালিনী দেবী এক আর্জি নিয়ে আঁকড়ে ধরলেন স্বামীকে, বললেন, মেজো জামাইকে জরুরি খবর দাও।
হঠাৎ আমেরিকা প্রবাসী জামাতার কথায় রবীন্দ্রনাথ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হন।
সত্যেন্দ্রকে? কেন বলো তো?
খুব শান্ত স্বরে মৃণালিনী দেবী বলেন,
খবর দাও, এখানে আসতে।
কী যা তা বলছ! তিন মাস পর ওর পরীক্ষা। এ সময়ে দেশে এলে চলে!
মৃণালিনী দেবী আর কথা বলেন না। গায়ের উপরে চাদরটা টেনে পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন। অসুস্থ স্ত্রীর কপালে হাত রাখেন, রবীন্দ্রনাথ জানতে চান,
তোমার কি শীত লাগছে?
নিরুত্তর ফিরে আসে প্রশ্ন। বিপন্ন হাতে স্ত্রীর গায়ের চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে দিতে দিতে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেন, 
সত্যেন্দ্রকে দেশে আনতে চাইছ কেন, সেটা তো বললে না!
মেয়েটার মুখের পানে তাকিয়েছ কখনো? সে সময় আছে তোমার?
মেয়েটা, মানে রেনুকার কথা বলছ?
রানীর অন্যনাম রেনুকা। বাবা তাকে দুই নামেই ডাকেন। কিন্তু মাধুরীলতার বেলায় কেবল ওই বেলা নামেই ডাকেন। মীরা কখনো কখনো হয় অতসী। মৃণালিনী বলেন,
হ্যাঁ, রানীর কথাই বলছি। ওইটুকু মেয়ের চোখেমুখে কেমন কালির ছাপ পড়েছে দেখেছ?
ও সব কালিঝুলি মায়ের চোখেই আগে পড়ে বুঝি!
মেয়েটার বিয়ে হলো, ফুলশয্যা হলো না। জামাইকে ডেকে আনো। আমি ওদের একত্রে দেখে যেতে চাই।
' যেতে চাই ' শব্দযুগল কানের দরজায় এসে সজোরে ধাক্কা দেয়। রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর শিয়র থেকে উঠে দাঁড়ান। আপন মনে পায়চারি করেন ঘরময়। মনে মনে উচ্চারণ করেন, যেতে চাই। তার মানে মৃণালিনী কি ভেতরে ভেতরে দূরের আহ্বান শুনতে পেয়েছে! অচেনা সুদূর তাকে হাতছানিতে
ডাকছে! তবে কি এই তার অন্তিম বাসনা! কই, বেলাকে নিয়ে তো তার উদ্বেগ নেই! তার মাতৃহৃদয়ের যত আকুলতা সেটা এই মেজো মেয়ে রানীকে ঘিরে। কী জানি কোন শ্রাবণমেঘের রৌদ্রছায়া দেখেছে সে রানীর চোখে! রবীন্দ্রনাথ পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসেন ঘরের বাইরে। কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা রাতের প্রকৃতি তখন মৌনব্রত পালন করছে। এরই মাঝে ভেসে আসে শিউলির ঘ্রাণ। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতেই সহসা চমকে ওঠেন-- এখন এ সময়ে শিউলি কোথায়! দেউড়ির বাইরে আছে বটে দু'ঝাড় শিউলি, সেও তো সারা আশ্বিন জুড়ে গন্ধ বিলিয়ে ফুল ঝরিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবার কথা। তবে কি ফুলেরা নিঃশেষে নিঃস্ব হয় না কখনো! নিরেট অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথ একাকী খোঁজেন শিউলিঘ্রাণের উৎস---'দূরে কোথায়, দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায়.... । '
অতপর মৃণালিনী দেবীর আন্তরিক পীড়াপীড়ি জয়ী হয়। জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে সুদূর প্রবাস থেকে ছুটে আসে মেজো জামাই। হ্যাঁ, শাশুড়ি তার অসুস্থ বটে, তবু সহসাই সে বুঝতে পারে যে চিকিৎসা গ্রহণের জন্যে প্রবাস থেকে ডাক্তার- জামাইকে ডাকিয়ে আনা হয়নি। কারণ অন্যত্র। চিকিৎসা গোল্লায় যাক, খবর পেয়েই জামাই এসেছে ভিনদেশ থেকে, এতেই তিনি মহাখুশি। হোক ফ্যাকাশে, তবু তার রোগকুঞ্চিত মুখে দিব্যি হাসি ফোটে। কীসে জামাইয়ের মন পাওয়া যাবে তা নিয়ে রানীর ব্যস্ততা থাক বা না থাক মৃণালিনী দেবীর উদ্বেগের অন্ত নেই। বনমালীকে একের পর এক ফাইফরমাশ করেও তার আশ মেটে না। শরীরে কুলায় না, তবু নিজে হাতে এটা- সেটা করতে উদ্যত হন। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে-মেজো জামাইয়ের জন্যে এত যে ব্যাকুলতা, বড় জামাই শরতের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটি কখনো দেখা যায়নি। বলা যায় রবীন্দ্রনাথের চোখেও এ এক অন্য মৃণালিনী।

সত্যেন্দ্রনাথ আমেরিকা ফিরে যাবার প্রায় মাসখানেক পর হেমন্তের এক গোধূলিবেলায় অস্তরাগে দিগন্ত রাঙিয়ে পরপারে চলে গেলেন মৃণালিনী দেবী। তখন অঘ্রাণের পাকা ফসল তোলার মৌসুম। পরিপুষ্ট ফসল ঘরে না তুললে ঝরে যাবার সময়। কিন্তু অপুষ্ট ফসলও কি এভাবে ঝরে যায়---ত্রিশ বছরের মৃণালিনী দেবীর মতো? মীরা ঝুঁকে আছে মায়ের মুখের কাছে, শমীন্দ্র বুঝতেই পারে না--- এটা কী হচ্ছে, সহসা এ কী ঘটে গেল! রবীন্দ্রকণ্ঠে তখন মন্ত্রের মতো মন্দ্রিত হয়-
'নমি হে ভীষণ, মৌন রিক্ত, এসো মোর ভাঙা আলয়ে....। 
'
রবীন্দ্রনাথ এই রকমই। শুধু কবি নন, তিনি দার্শনিকও। মৃত্যু চরম রহস্যময়। সেই ঐশ্বর্যময় রহস্যেরও ব্যাখ্যা খুঁজে নেন নিজের মতো করে। তাই শোক তাঁর কাছে একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে গণ্য হয়, বাইরে তিনি সম্পূর্ণ অবিচলিত। ঝড়ের আঘাতে তালগাছ সাধারণত ভেঙে পড়ে না। তবু তার মাথার দিকে তাকালে উদ্ভ্রান্ত পত্ররাজি বলে দেয় বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে সে কতটা যুঝেছে। চুলদাড়ি আচ্ছাদিত এই মানুষটির চেহারার কোথাও সেই যুদ্ধস্মৃতি কিংবা ক্লান্তির লেশমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমস্যা হলো রানীকে নিয়ে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই সে অসুস্থ। কিছুই ভালো লাগে না তার। গলা ব্যথা। ঘুসঘুসে জ্বর। ডাক্তার-কবরেজ দেখিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। নতুন স্কুলের কাজ ছাড়াও এখানে আরও কত যে কাজ ছড়িয়ে আছে! সেই কাজের ঘোরে ডুব দিলে ব্যক্তিগত শোক তখন মুখ লুকায়। তাই বলে দায়িত্ব কর্তব্য কি বিস্মৃত হয়!
রানীর অসুস্থতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত। উদ্বিগ্ন।

ডাক্তারেরা প্রথমে ভেবেছিলেন গলক্ষত, শক্তিশালী ওষুধপত্রে ঠিকই সেরে যাবে। কিন্তু না, দিন গড়ায়, অসুখ বাড়ে। ছোট বড় সবার মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। আতঙ্ক দুলে ওঠে চোখের তারায়-- রানী কি গোপনে গোপনে মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে? দুর্ভাবনায় গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে কারো কারো। রবীন্দ্রনাথ ডাক্তারকে চেপে ধরলে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানান, রানীর হয়েছে যক্ষা। হাওয়া বদল অত্যন্ত জরুরি। রানীর সঙ্গে মীরা এবং শমীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চললেন হাজারিবাগ, স্বাস্থ্যকর জায়গায়। বাব্বা, পথের সে কি ঝক্কি! গিরিধি থেকে নিতে হয় পুশপুশ, এক প্রকার পাল্কিগাড়ি। কী যে অস্বস্তি! তিন মাস পর দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আবার আলমোড়া। এবার মীরাকে রেখে এলেন কলকাতা। একা হাতেই রানীকে ওষুধ খাওয়ান, পথ্য দেন। এদিকে রানীর শরীরের বিশেষ উন্নতি নেই, একাকী নিঃসঙ্গতায় ছটফট করে, খিটখিটে মেজাজে বাবাকে বিরক্ত করে।
আমি আর ওষুধ খাব না বাবা।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন রবীন্দ্রনাথ, ধরা গলায় প্রশ্ন করেন, কেন খাবিনে মা?
ওষুধ খেলেই কি অসুখ সারে? আমার মার অসুখ সারেনি কেন তাহলে?
কী জবাব দেবেন বাবা! আজকাল এই হয়েছে এক জ্বালা। কথায় কথায় কেবলি মায়ের প্রসঙ্গ উঠে পড়ে। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেকেই আটকে যেতে হয়। এই তো কদিন আগে কবিতা শোনাতে গিয়ে যেই না বলেছেন, 'তুমি যাচ্ছ পাল্কিতে মা চড়ে... ' অমনি চেপে ধরে রানী, পাল্কিতে চড়ে মা কোথায় যাচ্ছে বাবা?
কবিতার মধ্যে মায়ের গন্তব্যের একটা ইঙ্গিত আছে বটে, তবু মেয়ের মুখের এই প্রশ্নের পর রবীন্দ্রনাথের কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। আর কিছুতেই মেলাতে পারেন না কোথায় যাচ্ছে ওদের মা, বীরপুরুষ সন্তানেরা মাকে রক্ষা করতে পারে কি না, তাও বুঝি জানা নেই। অপলক চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাবার অসহায়ত্ব দেখে ম্লান হাসি ছড়িয়ে অতি সহজেই জানিয়ে দেয়, আমিও একদিন মার কাছে চলে যাব দেখো। বাবা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে আড়াল করেন। খানিক পরে অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, চল, একদিন আমরা ওই পাহাড়ের চূড়া থেকে বেড়িয়ে আসি।
হঠাৎ এ প্রস্তাব দেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবেন, এই অসুস্থ মেয়ে নিয়ে আদৌ পাহাড়ে ওঠা সম্ভব? মনে মনে প্রত্যাশা করেন, মেয়ে যেন প্রস্তাবে রাজি না হয়। রানী কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বলে,
কেন বাবা, ওই পাহাড়চূড়ায় কি আমার মা আছে?

না না, ওখানে তোর মা কী করে যাবে?
তাহলে আমিও যাব না।
আচ্ছা।
এভাবে সেদিনের মতো নিষ্কৃতি খোঁজেন রবীন্দ্রনাথ। রাতের বেলায় দক্ষিণ দিকের বারান্দায় মেয়ের মাথার কাছে বসে একদিন তার শৈশবের গল্প শোনান। খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে রানীর মতোই কষ্ট পেয়েছেন --- সেই গল্প বলেন। অল্প চেনা জানা বাবামশাইয়ের গল্প বলেন। খুব উৎসাহের সঙ্গে বলেন,
তোরা মনে করিস তোদের দাদুমশাই খুবই গুরুগম্ভীর। আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু আসলে তা নয়। ভেতরটা একদম কাদামাটির মতো নরম। বাবুমশাইই তো আমাকে প্রথম পাহাড় দেখান, আকাশের নক্ষত্র চেনান। খুকি, তুই নক্ষত্র চিনিস?

চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত রানীর মুখ।তবু কপালের ভাঁজে কষ্টের ছাপ। সে বলে, না তো বাবা! আমার মা যে গিয়ে কোন তারাটা হয়েছে, আমি তাও জানিনে।
কে বলল -- তোর মা এখন তারা হয়েছে!
কেন, সেই কবেই তো বড়দি বলেছে!
অ।
ছোট এই অপবিশ্বাসটুকু আর ভাঙতে চান না রবীন্দ্রনাথ। কত মানুষই এ রকম কত না ভুল বিশ্বাস নিয়ে বাঁচে! রুগ্ন এই মেয়েটি যদি ওই বিশ্বাসে বুক বাঁধে তো বাঁধুক, তাতে এ সংসারে কার এমন কী ক্ষতি! কী ভেবে, নির্ঘুম সেই রাতে হঠাৎ তিনি এক বেফাঁস প্রশ্ন করে বসেন ---
তোর কি কখনো আমেরিকা যেতে ইচ্ছে করে মা?
রানীও দুম করে জবাব দেয়,
না তো! আমেরিকা যাব কী করতে?
রবীন্দ্রনাথও থমকে যান। এরপরে কী প্রশ্ন করতে হবে, সেটা যেন প্রস্তুত নেই। মনে মনে হাতড়ে ফেরেন। হিসেব মেলান,
ওর মা পাশে থাকলে এই মুহূর্তে কী প্রশ্ন করত? অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফ্যালেন, সত্যেন্দ্রকে দেখতে ইচ্ছে করে না তোর?
এতক্ষণে বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় রানী। মুখে কোনো জবাব দেয় না। রবীন্দ্রনাথ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভেবে পান না, না-বুঝে এ কোন সত্যে আঘাত করেছেন তিনি! কপালে হাত রাখতেই রানী সে হাত নামিয়ে রাখে। বুঝিবা গোপন করতে চাওয়া এক দীর্ঘশ্বাস কাঁপিয়ে দেয় তার শরীর। বাবার বুকেও তোলপাড়। মমতারস নিংড়ানো কণ্ঠে ডেকে ওঠেন,
রেনুকা!
রানী একবার চোখ মেলে তাকায়। সে ভাবে, বাবা তো সচরাচর এ নামে ডাকে না তাকে! কী হয়েছে বাবার? না, বাবার মুখের দিকে না তাকিয়েই সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তখনই আবার বাবা ডাকেন,
মা, তোর ঘুম পাচ্ছে?
দু'পাশে মাথা নাড়ায় রানী। রবীন্দ্রনাথ খুব সন্তর্পনে শুধান,
কখনো এমন মনে হয় খুকি--- মাকে পেলে এই কথাটা ঠিকই বলতাম? এমন হয় মা?
রানী পাশ ফিরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেমানুষের মতোই ডুকরে কেঁদে ওঠে। বাবা তাকে কাঁদতে দেন, সান্ত্বনার হাত বাড়ান। মনে হয়--- কাঁদুক, কেঁদে যদি খানিকটা বরফ গলে ভারমুক্ত হয়! কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত সে ছেলেমানুষের মতোই আবদার জানায়, বাড়ি যাব বাবা।
এই আবদারটুকুই এরপর প্রতিদিনের পীড়াপীড়িতে অকাট্য জিদে পরিণত হয়। সেই জিদ কখনো কান্নার হ্রদে মিইয়ে যায়, কখনো বা চিৎকার কোলাহলে রূপ নেয়। তখন আর সে প্রকৃতিস্থ থাকে বলে মনেই হয় না। রবীন্দ্রনাথ ভেবে পান না, কী কথা গিয়ে কোন ঘাটে ভিড়ে এই অবস্থা সৃষ্টি হলো। মেয়ের শরীরের যেটুকু উন্নতি প্রথম দিকে চোখে পড়েছিল, তাও দিনে দিনে হারিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তার জিদের কাছেই হার মানতে হয়।
কলকাতা ফিরে আসতে আসতে রানীর শরীর আরো খারাপ হয়ে আসে। পাখির ডানার মতো সরু লিকলিকে শরীর। হাত-পায়ে বল শক্তি আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু মনে খুব জোর। গলার স্বর নাঁকি হয়ে এসেছে তবু সে আবদার করে, আমি একটা কবিতা বলব বাবা?
কবিতা বলবি তুই?
হ্যাঁ,তুমি আলমোড়ায় শোনাতে যে, তাতেই আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। বলব বাবা?।
নাঁকি স্বরের কথা রানীর। সবাই বুঝতে পারে না। কেবল রবীন্দ্রনাথ মেয়ের মুখের কাছে মাথা নামিয়ে সম্মতি জানায়,
বল মা, শুনি।
এতটা বেদনাক্লিষ্ট মুখেও রানী এক চিলতে হাসে। নাকি হাসির মতো বিভ্রম কে জানে! রানী কবিতা শোনায় :
খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা, খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ / ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি,আমরা যখন উড়িয়েছিলাম ফানুস....।
রানীর কণ্ঠে শেষের শব্দগুলো আর মোটেই স্ফুট হয় না। রবীন্দ্রনাথের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে মুক্তোর মতো অশ্রুকণা। তখন তার প্রাণের গভীরে প্রার্থনার মতো একান্ত নিভৃতে মর্মরিত হয় গীতিমূর্চ্ছনা :
আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি তবুও আনন্দ
তবুও অনন্ত জাগে..... ।

No comments

FACEBOOK COMMENT