সিদরাতুল মুনতাহা বর্ণ
স্বর্গঙ্গা
সিদরাতুল মুনতাহা বর্ণ
দেবতা তুমি;
পায়ে চুমু খেয়ে ঘোর পাপের দায়ী করো না গো আমায়।
তোমার বজ্রাধুংকার পিঠে বিঁধে দেয়া ভগ্ন সভ্যতার কাঁচ
আমার চীবর জুড়ে সুঁই-সুতো হাঁটিয়েছে কতকবার।
তোমার বাহুর গায়ে আটকে থাকা অসুরের আঙ্গুলছাপে
পাহারা দিয়েছি আমি, প্রহরি-রতিদেবী, কতোবার;
আর কতবার-ই না তুমি চন্দ্রানুভূবিন্দু ছাড়িয়ে
ঠেকেছো নৈঋত অন্তিম দেয়ালের আড়ালে।
মন্দার খোঁজার বাহানায় ক্রন্দসী হটিয়ে লুটায়ে পড়লে তুমি
এই নকশিমাঠের ঈষাণ কোণে সেদিন।
পাহাড় চড়বে ভেবে ডুবসাঁতারে রয়ে গেলে মন্দাকিনীতে।
দেবতা তুমি;
অত্রস্ত অঙ্কুশ হাতে স্বর্গ-দুওয়ারে বসে থাকা আর
খোঁপায় আফশাঁ গুঁজে সুগন্ধি-জল ছেটানো
তোমার-আমার সাজে।
বিলাসবহুল জলটুঙিতে ঘটা করে সঙ্গম
তোমার-আমার সাজে।
অথচ দেখো,
দিব্যি শেওলা-ছাতার সংসার করে বেড়াচ্ছি আমরা দুজন।
দু'বেলা ভাতের মাড় ফেলার সময়
তোমার ঢাকনা ধরা হাতে হাত রেখে
কতো সহজেই আদিখ্যেতা করে সুর বুনছি আমি।
আলুথালু সকালে জয়তুনরঙা শাড়ি পরিয়ে
টিপের সাথে কি আনন্দে কপালে চুমু খাচ্ছো তুমি।
অগ্রহায়ণের মাঠে নকশাকাটা চাল কাঁধে তোলার সময়
এইযে গামছা ভিজিয়ে ঘাম মুছে দিচ্ছি আমি।
বেলা শেষে আরাম করেই আমার চোখে-মুখে,
কোমড় ছাড়িয়ে পায়ের গোড়ালিটকুও মালিশ করে দিচ্ছো তুমি।
বাদামী ছাউনির মেঝেতে প্রণয়সময়াক্ষণে ঠোঁটের শিরায়
কি সুন্দর অলৌকিক স্বর্গ বানিয়ে দিচ্ছো তুমি।
আর রোজকার দিনের মতোই প্রতি কাটা ঘুরার সাথে
তোমাকে 'দেবতা' আবিষ্কার করছি আমি।
এইযে দ্যাখো,
স্বর্গে নকশিকাঁথায় আলিঙ্গন শেষে,
দিব্যি মানুষ হয়ে রোজ জন্মাচ্ছি দুজন।
দিব্যি মানুষ হয়ে আমরা রোজ ভালোবাসছি দুজন।
অমোঘ সভ্যতা
মৃত সমুদ্র ঘেঁষে আলোক-মুঠোয় হেঁটে বেড়াই আমি
আর তিনটে খসা তারা আমার হাতের চন্দ্রিকায়
তৈরি করে নতুন ঝুলন্ত উল্কাপিণ্ড,
আমার উল্কাপিণ্ড হয় আবার নীলরঙা; যা
কাগজের ঠুঙোয় বুক পকেটে গুঁজে রাখি আমি।
ঠিক যেভাবে গুঁজে রেখেছিলাম ছোট্ট নুড়িপাথরটি।
গোলাপ সাজিয়ে রাখবার অভিলাষ ছিলো না বটে।
কিন্তু ওমন করে কঙ্করটি তুমি কুড়িয়ে নিয়েছিলে
যেন তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে নুয়ে পড়েছিলো নতুন কুড়িটি,
যেন পশ্চিমের দেল গ্রেজির সজ্জিত যীশু
মুখে নিয়েছিলো তাঁর অন্তিম নৈশভোজটি,
যেন গের্নিকায় নীল আর্তচিৎকারে মৃদঙ্গ বাজিয়েছিলো গ্রামটি;
তোমার ছোঁয়া ঐ পাথরটি কুড়িয়ে নিতেই
আমি দেখেছিলাম পঁচিশে কালবোশেখ,
একাত্তরের শীতের চৌদ্দে বুদ্ধির সব পতন,
পচাত্তরের শ্রাবণধারায় বত্রিশ নম্বর বাড়ি
আর নিথর পড়ে থাকা বুকে আঠারো সব বুলেট!
যাই হোক, ফেলে দেয়া তোমার সেই ছোট্ট নুড়িপাথরটি
আজ ভালো-ই আছে হৃদে,
ভাগাড়ে ফেলা হয়নি কিছু-ই।
ভালোবাসার সুতোয় গেঁথে গ্যাছে সেই কিছু সময়।
সেই কিছু ছন্দ, সেই কিছু প্রাণ।
এই অলোকসামান্য অনুভূতি,
এই ভালোবাসা, ছুঁয়ে যাক অগ্রহায়ণের পিঙ্গল পঞ্জিকা,
দ্বিজ মহির অম্বর, মরচে পড়া কিউপিডের তীর,
এবং তোমার ধোঁয়া লাগা বাঁ চোখের কোণ।
ছুঁয়ে যাক তোমায়।
ভালোবাসা ছুঁয়ে যাক তোমায়।
নকশাপট
নকশিকাঁথা,
তোমার পুর্নান্ধু বিকলাঙ্গের পিঙ্গল
অশ্বিনীর বুকে লুটায় পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে
তুমি কি অতি ছোট ঘাস হয়ে ভূমিষ্ঠ হও দেবলোকে?
তুমি কি মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের চওড়া ধমনিতে
সঞ্চারিত রক্তে নৌকা ভিড়াও কারখানায়?
তুমি কি দেবতা হয়ে ফিরে আসো রঙিন দেবীর চরণে?
নকশিকাঁথা?
তুমি যখন সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে চুমুর পাতায় ঠোঁট লিখে দাও,
চোখালোকপাতে হৃদ বিঁধে দাও,
তুমি যখন মেঘে ঘেঁষে গা ভিজিয়ে এসে বসো আমার আঁচলে,
তুমি তখন কি ভাবো বলো তো?
তখন তুমি আমার বুঁকের পাশে ঘর বেধে;
তুমি তো দেখি দিব্যি খেলা করো মাঠে।
ক্ষুধা পেলেই তুমি আঁকড়ে ধরো অশ্বনীর দুওয়ার।
হাত পেতে চাও অমৃতধোয়া সিন্দুকতালা।
তোমার কি নিজেকে হলুদ পাতার ন্যায় এক মনে হয় না?
তোমার কি নিজেকে তখন ঘরহীন মনে হয় না?
মনে কি হয় না যে তুমি অকারণে-ই দেবসদৃশ দেবত্ব মেনে নাও?
তুমি, তুমি কি সত্যি-ই আমায় ঘরেশ্বরী মেনে
কমলারঙা রোদের খামে বৈষ্ণব ভিক্ষু দীক্ষা দাও?
তুমি কি সত্যি-ই তোমার দেবলোকের উদাসে
স্বপ্নৈক ভ্রান্তে কিংবা নিগূঢ় প্রতীকে আমায় দেবী দেখো?
তুমি কি সত্যি-ই আমায় 'আমার বাসা' আঁকো?
হ্যাঁ?
তুমি কি সত্যি-ই 'আমার বাসা' আঁকো?
সময়-অট্টালিকা
সময়ের এই আশ্চর্য অট্টালিকা যদি একদিন
কোনো এক প্রকান্ড ভূমিকম্পে ধসে মিলিয়ে যায় মমতাময়ী মৃত্তিকায় ;
তবে আমি নিশ্চিত,
সময়ের সেই ভগ্নস্তূপেও আমি বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হবো নিন্দুকের দ্বারা।
কিন্তু খানিক সূক্ষ্ম অনুসন্ধান করে দেখো,
দেখা যাবে সেই অট্টালিকার একেক কামরায়
ইতিহাসের ছায়া একেক রঙের।
একেক ইতিহাসের 'আমি' যেন একেক প্রকৃতির।
কোনোটিতে আমাকে পাওয়া যাবে নশ্বর অগ্নিকণা হিসেবে,
আবার কোনোটিতে আবিষ্কৃত হবে আমার একান্ত অচিন এক শৈলগহ্বর।
কখনো ঝন্ঝার মতো উদ্দাম সিন্ধুজোয়ার,
কখনো বা খুঁজে পাবে অতলান্ত নির্ঝরিণী।
হ্যাঁ।
সময়ের চপলতা কিংবা গতিহীনতা আমায় বিঁধেছে বারম্বার।
মাঝেমধ্যে কোনো ঘর ছেয়ে গিয়েছে স্নিগ্ধ ঝলমলে চন্দ্রিকায়,
তো এই বুঝি কোনো চিলেকোঠা গ্রাস করলো ভয়ানক গাঢ় অমাবস্যা।
পরক্ষণেই অন্য এক কুঠিরে শুরু হয় প্রবল কালবোশেখি
কিংবা কোনো কালরাত্রে নিজেকে পাই অতন্দ্রিতা হিসেবে।
এমন-ও হয়েছে সেই গুমট অট্টালিকায়
নিজেকে নিজেই উন্মাদ করে ছেড়ে দিয়েছি ছোট্ট কুঠিরে।
অথবা বাঁধা এক ছাদে পৌঁছে রক্তিম নয়নজোড়া
অশেষ শূন্যে স্থাপন করে বিকট চিৎকারে কাঁপিয়ে দিয়েছি
ভীষণ ব্যাক্তিগত এই সময়ের অট্টালিকা!
অথচ সেই অফুরন্ত কাল পার করে আমি আবার অজানা কোনো সালের
এক ফাগুনের হাওয়ায় দোল খেয়ে,
খোঁপায় রক্তজবা গুঁজে,
হাসিমুখে এসে সমাজের সাথে কাঁধ মিলাই বলেই হয়তো
সময়-অট্টালিকাটি প্রীতি-উপহারে পুনরায় আমার জন্য দাবানল প্রস্তুত করে!
আমি আবার ফিরে যাই ঐ বিবর্ণ স্থানে...
হাসি, কাঁদি, দগ্ধ হই...
তবুও কেন যেন সেই সময়-অট্টালিকাকে ছাড়তে চাই না!
"জগৎ-সংসার"
(আঞ্চলিক অনুবাদ- হাসান আশরাফুল সজল)তোমাকে লিয়্যা হার কষ্টের স্যাস আছে কি গো জীবন হামার?
তুমি কি এই মানুসটার বেদনা একটুকুনও বুইঝব্যা না?
তুমি হার কাছে আইনূ আইনু কইহ্যা
এতো ম্যালাবার চেস্টা কইর্যাও তো স্যাসে ঠিকি আইসল্যানা!
এই রাইত এখন হামি কেমন কইর্যা কাটাবো কহোতো?
এই যে তোমাকে হামি এতো ম্যালাবার চ্যাহাও আইজক্যা
দেখতে পাইনুনা গো ময়না!
এই দুটা চোখের পাতা হামি এখন ক্যামন কইরা বুঞ্জাবো রে?
এই দুনিয়াটা হামার আর সইজ্জই হই ন্যা, জানো কি সেট্যা?
এই যে একটু মনে করা কি যাইব্যে না?
এই দুনিয়ায় সুদ্ধু একটাও মানুস নাই, তুমি আর হামি খালি;
হারা যেনে দোড়াছি, খাছি, লাচছি;
হারাকে থামাইবে কে?
তুমি হামাকে ফুল আইন্যা দিছো, কেহু দ্যাখার নাই রে সোনাই!
হামি তোমাকে হার কোলখানটাতে শুইতে লিয়েছি,
কেহু গাইল দিবার খানটাও নাই রে!
মনে করো এই সমাজখানটা কুনঠে জেনে হারিয়ে গেছে,
এত এত সোনা দিয়্যা হামাকে সমাজ থাইক্যা আর কিন্যে দিতে হইবে না গো তোমার,
নুন-ভাতে যদি পান্তা ফুরিয়্যা যায়, টাটাকা ইলিশ ভাইজ্যা খাইয়্যা দিবা,
ভালো মন্দ দুটা সিনেমা দেখতে লিয়্যা যাইব্যা তোমার
'স্কুটি' কোহ্যে ডাকো যে মইরচ্যা পড়া সাইকেলখানটা কইর্যে,
রাজ্জাক যখন সাবানাকে কোলে লিবে,
সিনেমা হলের পত্থম সারিতেই তুমি হামার গালখানটা টাইন্যা ল্যিয়া চুমা খাইয়্যে দিবা মুখে ম্যালাগালা।
কেহু দ্যাখার ভয়ে ডরাইব্যানা তুমি।
এরকম চিন্তা কইরল্যে কেমন হয় কহ তো?
দুনিয়া করার পর আর কুন্ঠি জাহান্নাম নাই;
খালি সুখ আর সুখ,
তোমার আর হার পাপ কেহু বাটখারা দিয়্যা লাপবে না,
সব-ই প্রেমের লাইগ্যা মাপ হইহ্যা যাইব্যে।
আল্লাহর কাছে হারা আরাখানটা জীবন চ্যাহ্যে লিব,
আল্লাহ হারাকে ম্যালা জীবন দিব্যে, ভক করে সেস হইব্যে না।
হারা খালি ভালোবাসব সারাদিন-রাইত
হারঘে খাওয়ার চিন্তা থাইকবে না,
পিন্ধার চিন্তা থাইকবে না,
চিন্তায় ভাইস্যা থাইকব্যা খালি তুমি,
আর হামি!
এরকম ভ্যাবতে পারব না, হার সোনাইটা?
Post a Comment