শান্তিময় মুখোপাধ্যায়
একটি আত্মপাঠ
শান্তিময় মুখোপাধ্যায়
কাব্যগ্রন্থ:"পাতার ওপর লেখা আছে আমার কিছু"
-- কামরুল বাহার আরিফ !
কোথায় কি যে লেখা থাকে বা কখন তা লেখা হয়ে যায় কেউ কি জানে? কবি শুধু জানেন একটা বই-এর পাতার বসন্ত নির্ঘোষে উড়ে যাবার উচ্ছ্বাস।তাতে কত রং,কত শুকনো পাতার দীর্ঘশ্বাস! কবি এইসব অবাকগুলো দেখেন। "বনে তোর লাগাস আগুন তবে ফাগুন কিসের তরে" --- রবীন্দ্রনাথের মতো ফাগুনে আগুন মিশ্রিত এই আত্মজিজ্ঞাসা তাঁরও।
কবি কি শুধু দেখেনই,শোনেন না --- পুরাণপাতায় অবতারের ঘুমিয়ে থাকা,অনৃত জলজীবনের অট্টহাসি আর ভোরের বাতাসে রাতের কুহেলিকা? এইসব ঝঞ্ঝাধ্বস্ত, অভিমানী মেঘের জৈব বহমানতা কবির জীবনে কখন পরম হয়ে ওঠে আমরা কেউ-ই তা জানিনা।মৌহুর্তিক ভালো লাগা থেকে নীলশাড়ি হরিণী সেকারণে কবির কাছে দেবী,পায়ে তার অপরাজিতার পুষ্পার্ঘ্য। যখন ভাবি কবি কেন এতো সুগন্ধী,বাহারি ফুল থাকতে গুলবাগিচার এই ফুলটিকেই বেছে নিলেন তখন অবাক হতে হয় বৈকি! মার্কেন্ডেয় পুরাণে অপরাজিতার বর্ণনা একরকম : নীলোৎপলদলশ্যামং ভুজঙ্গাভরণান্বিতান / শুদ্ধস্ফটিকসঙ্কাশং চন্দ্রকোটিনিভাননাম।অর্থাৎ নীল পদ্মপাপড়ির মতো সর্পাঙ্গী শ্যামজা যেন শুভ্রস্ফটিকের উপর কোটি চাঁদের কিরণ বিচ্ছুরণ করছে।এ উপমা শারদশশীর দেবী মাহাত্ম্য।দুর্লঙ্ঘ্য অজপাতে কবির মানসলোকে প্রস্ফুটিত হয়েছে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেকালে রাজা-রাজড়ারাও শরৎকালে নবরাত্রি পার করে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতেন।কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও এই সময়টিই যুদ্ধযাত্রার প্রশস্ত সময় বলে উল্লেখিত।তাছাড়া স্মার্তপন্ডিত রঘুনন্দনও তাঁর 'তিথিতত্ত্ব' বইয়ে মন্তব্য করেছেন, যে রাজা দশমী পার না করে যুদ্ধে যাবেন তার পরাজয় সুনিশ্চিত। নীল অপরাজিতা কবিতায় কবি কামরুল বাহার আরিফ যেন এই সন্দর্ভগুলোই পাঠককে কিছুটা চোরাচালিত করে মনদেবীর যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি সেরে নিলেন।
তবু কিছু কথা যেন রহিয়াই যায়।যা খুব দুর্বোধ্যও নয় আবার সহজবোধও।কিছু ঈশারা থাকে মাত্র।যার বিনিসূতোয় নগরীর উত্থান-পতন, গরিমা-ম্লানতার ক্ষুব্ধ ইতিহাস কবিতার জীয়নকাঠি হয়ে ওঠে।সেরকমই একটি কবিতা "না কোনো সহজ কথা না"। এখানে 'চর্যার ঢেউ' যেন সেই স্বপ্নলোকের চাবি। ভৌগোলিক প্রেক্ষায় উত্তর বিহার,কলিঙ্গর কিছু অংশ,বঙ্গদেশ আর কামরূপ প্রধানত চর্যাপদের পটভূমি।রাষ্ট্রিক বিধিনিষেধের বাইরে দাঁড়িয়ে পদকর্তাগণ নদীমাতৃক বাংলার সুখ-দুঃখের নানা জীবনকথা এখানে গেঁথে রেখেছেন দ্ব্যর্থহীন সান্ধ্য ভাষায়।নৌযাত্রার বিবরণ থেকে শুরু করে নদ-নদী,শিকার,জীবিকাপ্রণালীর নানা খন্ডচিত্র সন্নিবেশিত এখানে।নদী-নৌকা-মাঝি-সাঁকো চতুবর্গীয় এই শব্দবন্ধ একারণে যেন সমগ্র চর্যার নিয়ামক হয়ে উঠেছে। " হালধরা মাঝি সরহ পা,লুই পা,কাহ্নু পা,ভুসুক পা/পাল তুলেছিলেন পরম্পরায় হরপ্রসাদ,সুনীতি,শহীদুল্লাহ"মনে করিয়ে দেয় "বিসরণ ণাবী কিঅ অঠকুয়ারী।নিঅ দেহ করুণা শূন্য মেহেরী।।তরিত্তাজলধি জিম করি মাঅ সুইনা।মঝ বেণী তরঙ্গম মুনিআ।।পঞ্চ তথাগত কিঅ কেড়ুআন।বাহসে কাহ্নি ল মায়াজাল।।..."
কবিতার আত্মপরত ভেঙে এগুনোর পথ কখনো আগলে দাঁড়ায় নক্ষত্রালোকের ঝাঁঝালো তামস।বিস্তীর্ণ আনন্দে ভাসা কান্নার মতো
আলোপাখিদের কাকলি তখন তমোনিরঞ্জন।বাহ্যিক সুরবৈভব থেকে চৈতন্য যেন বেজে উঠছে ছন্দ আলুলায়িত প্রাণে। কাগজে লেখা ভাবনাভাষা প্রলেপকারার বন্দীত্ব তুচ্ছ করে দুবাহু উৎকীর্ণ করে গাইছে "আমারে যে বাঁধবি কে রে,সে বাঁধন কি তোদের আছে?"
পাঠকের কি মনে আছে বেগম সুফিয়া কামালের 'হেমন্ত' নামের সেই কবিতাটি --- "সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/আনলো ডেকে হেমন্তকে?" স্মরণে এলো কবি কামরুল বাহার আরিফের 'গর্ভের পবিত্র রঙে নত হই' কবিতাটি পড়তে গিয়ে।এই কাব্যগ্রন্থে কবি যে উচ্চতায় কবিতাটিকে নিয়ে গেছেন তা যেন আবহমান বঙ্গদেশের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবিবরণী। কবিতার শেষ দু-লাইন : "নত হতেও শক্তি থাকা প্রয়োজন।/হেমন্তের বরেন্দ্র প্রান্তর গর্ভের পবিত্র
রঙে কী উজাড় করা সুন্দর!" আপামর অবচেতনার ভাঁজ খুলে যেন দেখাতে চাইছে হেমন্তের সামগ্রিক ইতিহাস।নতুন চালের গন্ধে ম' ম' করা আপাত রুক্ষ,শান্ত এই ঋতুটির দ্বিতীয় মাসটিকে সম্রাট আকবর কি প্রকৃতিকে এরকম ফলবতী হতে দেখে বছরের প্রথম হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন! কৃত্তিকা ও আর্দ্রা নক্ষত্রের নামানুসারে যথাক্রমে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের কথাও অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন।তা সে যাই-ই হোক, এই কবিতায় এমন এক মানবিক মুখের কথা উল্লেখিত যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গী।ইনি নরোত্তম দাস(১৫৩১-১৬১১)। অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার প্রেমতলীর পদ্মাতীরবর্তী গোপালপুর, খেতুরিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হয়েও অবিসংবাদী এই পন্ডিত ও কবি মানবপ্রেমে ব্রতী হয়ে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।শুধু তাই-ই নয়, তাঁর রচিত বেশ কিছু কড়চায় বাংলা গদ্যের প্রাচীন রূপ লক্ষিত হয়।নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে এই বরেন্দ্র ঋষি এভাবে বর্ণিত : "অতিবৃহদ গ্রাম শ্রীখেতুরি পূণ্য ক্ষিতি।/মধ্যে মধ্যে নামান্তর অপূর্ব বসতি।/রাজধানী স্থান সে গোপালপুর হয়।/ঐছে গ্রাম ধণাঢ্য বৈসয়।" কথিত যে শ্রী চৈতন্য একবার আবেগ বিহ্বল হয়ে পদ্মার দিকে তাকিয়ে এই মহামানবের নামে অশ্রুপাত করেছিলেন। কীর্তনের বহু ঠাট ও রীতির প্রবক্তাও এই নরোত্তম দাস।রানিহাটি বা রেনেটি গরাণহাটি প্রভৃতি কীর্তনরীতি এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য। খেতুরি তখন যেহেতু গরাণহাটি মহকুমার অন্তর্ভূক্ত ছিলো তাই সেই স্থানের নামানুসারেই এই রীতির নামাঙ্কন বলে গবেষকদের অনুমান।
আসলে এই বইয়ের প্রতিটি কবিতাই যেন এক একটি প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে আমাদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে।আপাত সরল বাক্যবিন্যাস পাঠককে বিভ্রান্ত করার এক মহামন্ত্র মাত্র।এর সাংকেতিক উচ্চারণে কখনো পূর্বমানুষের পুনর্জন্ম বৃক্ষে।অবস্থান আর কাঠামোর প্রতিবর্ত উদগীরণে যা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।শুধু তাদের প্রগাঢ় ছায়া বরাভয় হয়ে পৃথিবীর ছাদ রূপে ঝুলে থাকে মাথার উপর।
Post a Comment