DEHLIJ

মোখলেস মুকুল

দ্য জার্নি

মোখলেস মুকুল






“একটি শোক সংবাদ! মনিরামপুর নিবাসি আব্দুল জলিলের পুত্র, নুরুল ইসলাম গতকাল  রাত এগারো ঘটিকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করিয়াছে, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেয়ুন... মৃত্যুকালে তাহার বয়স হইয়াছিল ছাব্বিশ বছর। মরহুমের হইবে । সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইদের উক্ত নামাজে জানাজায় যোগদানের জন্যে বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাইতেছে...


বহু দূর থেকে মাইকের ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট আওয়াজ ঢেউয়ের মতো ভেসে আসে, পরপর তিন বার অথবা তারও বেশি । বুকের ভেতর ছ্যাত করে ওঠে! নাম ঠিকানা বয়স,  হুবহু মিল! তাহলে আমি মৃত! তবে শুনতে পাই কেন? পরিস্থিতি আচ করতে চোখ মেলি, চাপ-চাপ অন্ধকার। আর কোনো শব্দই কানে আসে না, পাতাঝরা নিরবতা । হাই ওঠে, মনে হয় মাত্র ঘুম ভাঙলো । মাথা শুন্য শুন্য লাগে, হাত-পা নাড়ি, সব ঠিক আছে কিন্তু নিজের কোনো অঙ্গের স্পর্শ পাই না। নিজেকে পাখির পালকের মতো হালকা লাগে, তাহলে কি বায়বীয় দেহ? স্থির না উড়ছি, বোঝা যায় না। চারদিক হাত-পা চালাই স্পর্শহীন! তারমানে আমি শুন্যে ভাসমান! অনিশ্চয়তায় ভেতরটা তোলপাড় করে; আমি জীবিত না মৃত, উড়ন্ত না স্থির, চিত না কাত, দাঁড়নো না শোয়া! আমি কোথায় ! 


নাকে গন্ধ আসে; মেসকে আম্বারা, নাকি ইথারের! হঠাৎ ঘোড়া ও মোটরযানের মিশ্রনে বেগুনী আলো-ছায়ার এক অদ্ভুত অধরা বায়ুযান ধীর গতিতে নিঃশব্দে আমার সামনে শুন্যে অবস্থান করে। অনেকটা নিমকি আকৃতির, সামনের অংশ ঘোড়ার ঘাড় সমেত মাথা, পিছনের অংশ কোণাকৃতির এবং দেখতে ছুটন্ত ঘোড়ার লেজের মতো আর ওটা দাঁড়ায় পেট থেকে বেড়িয়ে আসা দুরন্তচালে ছুটে চলা দুলকির চার পায়ের উপর | ভেতরে না-রোবট না-মনুষ্যাআকৃতির বেগুনি আলো-ছায়ার ছয় অশরীরী বসা। ঘোড়ার কপালের উপর আরবী বর্ণমালার দ্বিতীয় অক্ষর “বা', অশরীরীর একজন সামনের আসনে তার বুকে 'জিম', তার পেছনে পাশাপাশি তিনটি আসনের মাঝেরটি ফাঁকা, তার দু পাশে দুজনের বুকে 'কাফ দুপাশের দুজনের আলিফ" এর খোদায় করা মনোগ্রাম। প্রত্যোকের কপালের নিচে রেডিয়ামের মতো একজোড়া চোখ ছাড়া সব অস্পষ্ট । এলইডি দ্বিনের মতো মোলায়েম বেগুনি আলো; বেগুনি সুবেহসাদেক তৈরি করে । ওরা কী ভিনগ্রহী! গা শিহরে উঠে !

মতো লাগে; জিম ইমাম, বাকি পাঁচজন দুই কাতারে । জিম'র নির্দেশে সে-সহ সবাই আমাকে কুর্নিশ করে । তারপর ওর যান্ত্রিক কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়, পথিক! নভনীলের খালি আসনে বসো। মনে হয় ভারী কণ্ঠে হুকুম দেয়া হচ্ছে, স্পষ্ট প্রাটান আরবদের কোরাইশ ভাষায় । সম্ভবত জিম-ই লীডার।


আমি জাদুটোনায় মোহ্গ্রস্তের মতো স্পর্শহীন নভনীলের খালি আসনে উড়ে গিয়ে বসি। ঘুমজড়িত কণ্ঠে কোরাইশ ভাষায় গোঙালাম কিছুক্ষণ, আমি মরে গেছি, আমি মৃত । ঘুমের ঘোরে থাকলেও আমার কান সজাগ । 

না, মরো নি। আদম-হাওয়ার মৃত্যু নেই । মানুষ মরে না। সামনে থেকে জিম গমগম শব্দে বলে।

আশ্চর্য! আমি পৃথিবীর সব ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারি। নাকি সব ভাষা কোরাইশ ভাষায় ট্রা্দলেট করে নেয় আমার মস্তিষ্ক! 


আদিপিতা, আদিমাতা মরেন নি! দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে নিতে নিজেকেই নিজে শুনিয়ে বলি। না। রুহ শ্রানান্তরিত হয় মাত্র। সেটা তেইশে তেইশে বিভাজিত, আবার মিলেমিশে  ছেচলিশে বাস করে । আবার তেইশে ভাগ হয়। আবার ছেচলিশে স্থান করে নেয়। এভাবে আদম-হাওয়া সংযোজন আর বিয়োজনের মাধ্যমে পর্যায় ক্রমে পূর্ব-পুরুষ হয়ে তোমার পিতামাতা থেকে তোমাদের মাঝে । তারপর তোমাদের থেকে তোমাদের সন্তানের মাঝে এবং ভবিষ্যতে...

উফ! মাথার ভেতর ঝিঝির ডাক শুরু হয়। কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে আসে । তোমরা কারা, কোথায় করি।


কোনো উত্তর নেই। লম্বা নিরবতা । চোখেরপাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আসে । মনে হয় আত্মহত্যার চেষ্টায় দু ডজন ক্লোনাজিপাম খেয়েছি। নভনীল কী ওড়ে? নিজেকে বরাবর ওজনহীন মনে হয় কেন? নিরবতা ভেঙে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে দ্বিরুক্তি করি।


এবার জিম উত্তর দেয়, এখন প্রথম ভ্তর । আরও ছয় স্তর আছে। কোথায়, কার কাছে নিয়ে যাবো, সময় বলে দেবে । তোমার বিচার হবে। নিরস অথচ দ্বিধাহীন কণ্ঠে লিডার বলে, যেন কোনো রেডিও ওয়েভ কানে আসে। 

আমার বিচার তো হচ্ছেই, ঘোরের ভেতর থেকে বলি। সে বিচার তো সত্তর হাজার, লক্ষ বা কোটি বছর আগে পৃথিবীতে হয়েছে।

কোনটি সঠিক, হাজার, লক্ষ না কোটি?

জানি না। এখানকার দিনরাতের সাথে পৃথিবীর দিনরাতের মিল নেই। হতে পারে এখানকার একটা দিন বা রাত সেখানকার একশ, পাঁচশ বা দশ হাজার দিন বা রাতের সমান বা তার বেশি ।


বিমুনিতেও গায়ে কাঁটা দেয়। কোথায় আমি, আসমানে! ওরা বলে প্রথম ভ্তর। মানে এক এক করে সাত আসমান! তাহলে ওরা যাকে নভনীল বলে এটা কী দাদার কাছে শোনা সেই প্রাণী সদৃশ আকাশযান! বোরাক না কী যেন। ঢুলুঢুলু কণ্ঠে বলি, মাইকিং শোনো নি? 

হ্যাঁ শুনেছি, সত্যটা হলো; ওরা তোমাকে খুন করার পর রাস্তায় ফেলে গাড়ি চাপা দিয়েছিল । স্ট্যান্টবাজি | 

আমি জিম"র মুখ দেখতে পাই না, অন্ধের মতো বালি, অ। অ, আচ্ছা । কিন্তু আমার বাবা তো সন্দেহ করে কেস করেছিলো । বিচারের রায় কী?





কী আর হবে! ডাক্তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অর্থাৎ ডেথ সেন্টেন্সে হোমিসাইড না দিয়ে গ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ দিয়েছিলো । তা না হলে তার শুধু চাকরিই যেতো না, গুমও হতো ।রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা । অমান্য করে সাধ্য কার ।

আমার পক্ষের সাক্ষীরা কী করলো? 
সাক্ষীদের খাওয়া আছে?
কিন্তু আমি যা করেছিলাম তা তো রাষ্ট্রের স্বার্থে । তারপরও কেন এমন করলো? 
তোমার আগে কতো জনেরই তো এমন ঘটেছে, ভুলে গেছো?
অ। অ, আচ্ছা । অদৃশ্য মাদকতা আমাকে স্বপ্নের ভেতর ঠেলে দেয়।

বহু, বহু দূর থেকে দুম...দুমা...দুম...দুম ... গুরুগন্তীর ঢোলের একটানা বাজনা শোনা যায়। ওটার কম্পন মস্তিষ্কের নিউরন থেকে এক্সোন হয়ে সারা গায়ে ঠান্ডা ঢেউ বইয়ে দেয়। মনে হয় কোথাও অবিরাম দফ বেজে চলে। চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। তুমি দ্বিতীয় স্তরের প্রবেশদ্বার, নামো। জিম'র কর্কশ কণ্ঠে ঘুমন্তভাব নিয়ে শিউরে উঠি। সব স্পর্শহীন, সেকেন্ডের ভগ্নীংশ সময়ের মধ্যে উড়ে উড়ে নামি, যেন হুকুমের গোলাম আমি ।

কাতারে । জিমসহ সকলে কুর্ণিশ করে। ইমাম যান্ত্রিক কথায় সংক্ষিপ্ত প্রতিধ্বনি করে, আলবিদা ।
বায়ুযান যেমন এসেছিলো ঠিক তেমন নিঃশব্দে হাওয়া হয়। কখন গভীর ঘুমে অসার হয়ে পড়ি, জানি না...




ঘুম ভাঙে বিকট শব্দে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা; ঘণ্টা! দিন! বছর! কত বছর? হাজার, লক্ষ না কোটি? ভাবনায় মনোযোগ আসে না। মনে হয় আশ-পাশের সবকিছু ভেঙে খানখান; যেনো পাহাড়ও টুকরা টুকরা হয়ে গড়ায়। চোখ মেলে ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা । নিজেকে আগের মতোই ওজনহীন লাগে। গাঢ় অন্ধকারে উড়ন্ত না স্থির, বুঝি না। আবার সুবেহসাদেক। সেই বায়ুযান নভনীল, এবার নীল রঙের আলো-ছায়ায়। পিছনের আসনে মিম নেই! পাচ অশরীরীও নীলাভ । নভনীলের খালি আসনে বসো । স্পষ্ট কোরাইশ ভাষা । 

আসনে বসে ডান পাশে কাফ কাফ'র দিকে হাত বাড়ালে স্পর্শহীন মনে হয়, তখন কোটি কোটি মাইল চলে গেছে; ধড়ে কাঁপুনি ওঠে । মাইরি, আর না।

কৌতুহল থেকে ওদেরকে জিজ্ঞাস করি, নিজেকে অস্তিত্বহীন পাতলা কাগজের মতো লাগে কেনো?

অ, আচ্ছা । তোমার ওজন হাইড্রোজেন বা হিলিয়ামের পারমানবিক ওজনেরও কম। সবসময় লিডার-ই কথা বলে । অন্যরা স্রেফ রোবট । যতো উপরে উঠবে ততোই কমবে। একসময় শুন্য হবে ।


শূন্য হবো? চমকে উঠি!
হ্যাঁ, ফানাফিল্লাহ।
তার মানে?

শূন্য থেকে শুরু, শূন্যে শেষ। অস্তিত্বের ঠিক আগের মুহূর্ত থেকে অস্তিত্ববান। আবার অস্তিত্বহীন । অস্তিত্বের কোনো সীমারেখা নেই, শুন্যেরও ৷ তাই দুটোর মধ্যে পার্থক্য নেই। এইসব কথা শুনে ওদের চেনা চেনা লাগে, আরবী অক্ষরগুলো মাথায় ঘুরপাক খায়, কোথায় যেনো নাম শুনেছি! হ্যা, শুনেছি, গ্রামের মসজিদের ইমামের মুখে । মুহূর্তে গা ভারী হয়ে যায়। তবুও কথা চালিয়ে যাই, এক কাজ করো, আমাকে আবার হত্যা করে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাও ।

মৃত্যুঃ এখন হাজারবার হত্যা করলেও মরবে না। বলেছি না, মানুষের মৃত্যু নেই? তোমাকেবিচারালয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।তবুও নিরুৎ্সুকের মতো বলি, অ। অ, আচ্ছা । নতুন কোনো ভাবনা মাথায় আনবো না,তাই জিজ্ঞাসা করি, বলতে পারো, আমার মা কেমন আছে? বাবা? তারা এখন অতীত, সন্তর লাখ বছর আগের কথা ।

জিম এমন তাচ্ছিল্য বলে, যেনো এক আধ কোটি বছর কোনো সময়ই না। এক প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পে পৃথিবীর সব নগরজনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে। মহাদেশগুলি আলাদা হয়ে গেছে। সকল প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। আমার চোখ ছানাবড়া হয় ! বিস্ময় ঢাকতে না পেরে বলি, অ। অ আচ্ছা ।

এমন অ অ করো কেনো? না, বুঝেছি।
কুত্তার ডিম বুঝেছো ।
এখন অই দেশে কুত্তা ডিম পাড়ে নাকি?
ঘোড়ার ডিম চেনো? তোমাদের দেশের লোকেরা এই কাজ হর-হামেশা করতো । ঘোড়ার
ডিম হলে কুত্তার হতে দোষ কী?

জিম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এখন আমরা সাত হাজার আলোকবর্ষ দূরে! আমার উদ্দেশ্যে সে বলে, এটা তৃতীয় স্তর... নেমে পড়, পথিক ।
আলবিদা।
আর কোনো কথা কানে যায় না...



এবার ঘুম ভাঙে শীতে কাঁপুনি দিয়ে। ধারণা সত্যি হয়, আমার গায়ে এ যাবত কোনো কাপড়ই ছিলো না। আশ্র্য! দেহ নেই অথচ সব অনুভূতি আছে। ভৌতিক অন্ধকারে আবারো সুবেহসাদেক আর অধরা নভনীল । এবার আসে আসমানি রং নিয়ে, অশরীরীরাও । আশ্চর্য! এবার পিছনের দুই আলিফের একজন নেই। চার জোড়া ভয়ঙ্কর রেডিয়াম চোখ জ্বল জ্বল করে । আগের মতো সবাই দাড়িয়ে কুর্নিশ করে। পথিক! নভনীলের খালি আসনে বসো । পূর্বের মতো জিম'র রোবটিক হুকুম । বিচারালয় কতো দৃরঃ সদ্য ঘুমভাঙা মানুষের মতো জড়তা নিয়ে বলি। সামনে । লিডারের সাদামাটা জবাব। 

পৃথিবীর খবর কী? আমি নিঃসংকচে জানতে চাই। সেখানে এখন বরফ যুগ। কতোদিন থাকবে? লক্ষ বা কোটি বছর, তারও বেশি হতে পারে । 
আচ্ছা, পৃথিবীর বয়স কতোঃ
যদি বলো দ্য আর্থ, সেটা আমাদেরও জন্মেরও কোটি কোটি বছর পরে ।
আশ্চর্য! তোমার বয়স কতো?
জানি না, মনে হয় হাজার হাজার কোটি বছর বা তার বেশি । পৃথিবী কি পরিবর্তনশীল


পরিবর্তন যাই হোক, প্রাকৃতিগতভাবেই পুববিস্থায় ফিরে আসে । মিসরের ফারাও এখন স্মৃতিচিহ্ৃ, হরগ্লা আর মহেঞ্জদারো নিশ্চিহ্ন, মেসোপটেমিয়া এবং গ্রিক ইতিহাস। পরবর্তী প্রজম্মের কাছে তোমরাও একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে ইতিহাস হবে। তোমাদের আগে পৃথিবীতে কতো সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তার কোনো হদিস নেই । যতো দাপুটে রাজা মহারাজাই হোক, একদিন ক্ষমতাহীন হয়।

আবারও দফ; দুম...দুমা...দুম..দুম... এই শব্দে বোধ হয় ঘুমের ইঞ্জেকশন আছে। জিম*র মুখ থেকে যান্ত্রিক শব্দ হয়, চতুর্থ স্তর, নামো। নেমে গেলে, সবাই আমাকে কুর্নিশ আর হুশ নাই।



এবারের ঘুম ভাঙাটা অন্যরকম । মনে হচ্ছে, কাদামটির মধ্যে ঘুমিয়ে । চোখ খুলতে ইচ্ছা করে না। অন্ধকারে চোখ খোলা না খোলা সমান। পথিক! নভনীলের খালি আসনে বসো। জিম'র হুকুম চোখ বন্ধ করা অবস্থাতে শুনেই বুঝলাম ওদের আগমন এবং ইতোমধ্যে ওরা আমাকে কুর্ণিশ করেছে । কৌতুহল বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখা যায় না। সবসময় নতুন কিছু আশা করি, আশ্চর্য! এবার ওরা সবুজ সুবেহ সাদেক নিয়ে এসেছে, সবকিছুই সবুজ! পিছনের আসনে কেউ নেই । যথারীতি উড়তে হয়। ভয় ভয় ভাব এখন পুরোপুরি নাড়ি সওয়া। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ওরাও নিজ থেকে কিছু বলে না। নভনীল আপন মনে ওড়ে । গতি কতো? চখের পলকের বেশি, নাকি কম? শুনবো? ধ্যাত, শুনে কী? এতোক্ষণে বোধ হয় পঞ্চম আকাশ ধর ধর। কতক্ষণ চুপ থাকা যায়? অগত্যা মুখ খুলি, নতুন কোনো খবর?

এখানে নতুন পুরাতন বলে কিছু নেই । মহাকালের গতির কাছে সব ছ্থির। এখন পৃথিবীর কোন দশাঃ 
কোন পৃথিবী? কোন পৃথিবী মানে! পৃথিবী কয়টা? জানি না। এটুকু বলতে পারি অসংখ্য । আমাদেরটার কথা বলো।  দ্য আর্থ? ওখানে এখন নতুন করে প্রাণী জন্মলাভ করতে শুরু করেছে। এক কোষি থেকে উভচর মাছ। মনে আছে তো, তোমাদের সময়ের বিজ্ঞানিরা এর নাম দিয়েছিলো কোয়েলাকান্ত।

একটি প্রশ্নের জবাব দেবে জিম , আমাকে কুর্ণিশ করো কেনো? ওকে কিছুটা বোকা বানানো এবং ওর ভাবান্তর কী হয় বোঝার জন্যে বলি। 

জিম বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো বলে মনে হয় না। বরং বলে, হাস্যকর প্রশ্ন করলে, এর গূঢ় উত্তর পৃথিবীর হোমো সেপিয়ে্স জানতো । 

ওহ, তাই তো! ঘুমের তালে বিষয়টা উপলোন্ধি করতে পারি নাই। যখন বুঝলাম তখন আমিই উল্টো বোকা বনে যাই। জানি না কতো হাজার কোটি বছর পর আপন মনে আবার ঘুমপাড়ানির গান, দুম... দুমা... দুম...দুম... অই বুঝি পঞ্চম স্তর !

জিম বলে, পথিক, নামতে হবে । আলবিদা । আমি নামলে, ওরা কুর্ণিশ করে চলে যায়। আবার ঘুম...


ঘুম ভেঙে গেছে। সময়কাল কতো হতে পারে? হয়তো পৃথিবীর কয়েক হাজার বছর বা তার বেশি বা কম। ঘুম ভেঙে গেলে এসব ভাবি। এবার যেন অন্য রকম লাগে, মনে হচ্ছে আমি সবুজ পৃথিবীর কোলে বসে আছি। তাহলে পৃথিবীতে কী নতুন কোনো ভাল খবর আছেঃ জানতে হবে । হয়তো এখনই আসবে ওরা।  পথিক! নভনীলের খালি আসনে বসো । জিমের যান্ত্রিক কণ্ঠ । ওদের নিয়মের হেরফের হয় না। ঠিক সময়েই অদ্ভুত আকাশযান আসে । অই তো! আমার তাকাতে দেরি হয় না। আরে, নভনীল এবং অশরিরীর দেহ থেকে মিষ্টি হলুদ রঙ ছড়িয়ে পড়ে! ব্যাপারটা মনে হয় রংধনুর সাতরঙে সাজানো; বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ... ভেবেছিলাম এবার আর একজন কমে যাবে । না, ওরা তিনজনই 
আছে, সামনে জিম এবং আমার দুপাশে দুই কাফ কাফ। যাত্রা শুরু হয়েছে । দেহ, মনে, প্রাণে আর জড়তা নেই । ঘুম ঘুম ভাব নেশা হয়ে গেছে, অনেকটা মদাশক্তের মতো, ভালোই লাগে ।


অস্থিরচিত্তে সবার আগে জানতে চাই, পৃথিবীর খবর কীঃ
ওটা পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
ধ্বংস হয়ে গেছে! আঁতকে উঠলেও তুষের আগুনের মতো ঘাপটি মেরে থেকে বলি, দ্য আর্থের কথা বলো।

ও আচ্ছা, জিম বলে।
বুঝলাম, বিশ্বচরাচরে অসংখ্য পৃথিবী প্রতিনিয়ত ধ্বংস আর সৃষ্টি হয়। দ্য আর্থ একদিন ধ্বংস হবে । অন্যসব পৃথিবীতে যারা আমার মতো মরে মানে রুহ স্থানান্তর করে, তারাও কি ফানাফিল্লার দিকে ধাবিত হয়? লিডারের কথায় আমার চিন্তায় বাধা পড়ে । 

দ্য আর্থ এখন নীল-সবুজের গ্রহ। ওতে নতুন করে সবুজবৃক্ষ, নীলসাগর আর অক্সিজেনঅলা বাতাসের ঢেউ লেগেছে । এখানে, সেখানে অসভ্য, বর্বর, উলঙ্গ মানুষ পাথরের হাতিয়ার দিয়ে পশু শিকার করে কাচামাংস খেয়ে পাহাড়ের গুহায় বাস করে । আর কিছুদিন পর চাষাবাদ শিখবে । খুব তাড়াতাড়ি সভ্যতার আলো পাবে ।

খুব তাড়াতাড়ি, মানে? জিমের কাছে জনতে চাইলাম । মানে দশ বিশ বা চল্লিশ হাজার বা লাখ বছর । জিম বলে। মনে মনে হাসলাম, হাজার, লক্ষ, কোটি... আচ্ছা, সভ্যতা ধ্বংস হয় আবার সৃষ্টি হয়, এভাবে পৃথিবীতে কতোবার সভ্যতা ঘুরে ঘুরে এসেছে, বলো না। আল্লাদে আটখানা হয়ে জিজ্ঞাসা করি। সব খবর আমাদের জানা নেই, শুধু ততোটুকুই জানি যা জানানো হয়, ততোটুকু বলি যতোটুকু বলতে বলা হয়। যা করার তা নির্দেশিত হয়ে করি । 

মনে ঝড় বয়ে যায়। কে জানায়? কে বলায়? কে নির্দেশ দেয়? জানি এ প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন পাবো না। 
দুম...দুমা...দুম...দুম... ঘুম ঘুম ভাব যষ্ঠ ভরে আগমনের সঙ্কেত দেয় । আলবিদা...



পৃথিবী সম্বন্ধে আরো অনেক কথা জানতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ঘুমে আমার দু চোখ জড়িয়ে কাশতে কাশতে এবার ঘুম ভাঙে । চোখ বুজে ভাবি, কাশছি কেনো? নিশ্চয় পৃথিবীতে যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়া, বাতাসে CO2, SO2, Lead...দূষণ। আকাশদুতের নিয়মের হেরফের হয় না। তাকানোর আগে ভাবি, রঙধনুর হিসেব ঠিক থাকলে এবার কমলা, তারপরেরটা লাল । তখনই কমলা রঙের নভনীলে কমলা রঙের অশরীরীরা হাজির । এবারো  তিনজন । কুর্ণিশ শেষ করে জিম বলে, পথিক! নভনীলের খালি আসনে বসো।


এসব মুখন্ত, বসতেই ওটা চলা শুরু করে। আমার ওজন সাত ভাগের ছয় ভাগ নেই । মন উসখুস করে, দেশের অবন্থা কী? বলো না ভায়া । এই প্রথম ওদের সাথে বাঙালিপনা করি । বোধ হয় বাঙালির রক্তধণ। বলার সময় ওদের ঠোঁট নড়ে কি নড়ে না, এই কৌতুহল আমার কোনোদিনই হয়তো মিটলো না । লিডারের কথায় মনোযোগ দেই।  এই মহাবিশ্বে কতো পৃথিবী, কতো দেশ আছে, জানোঃ
কোনটার কথা বলছো?
আমেরিকা, রাশিয়া, লন্ডন এসব আর কী । বলেই মনে মনে হিসেব কষি, এখানে মাটি দুরের কথা, বাতাসও আছে কিনা সন্দেহ। 

রাখো তোমার ঢাকা মাকা। কতোবার প্রলঙ্কারী ভূমিকম্প হলো, জানোঃ দ্য হিমালয়া এখন উত্তর মহাসাগর । দক্ষিণ মহাসাগর আর সাগর নেই, এখন সেখানে বার্মি চাষ হয়।

বার্মিঃ চোখ বুজে ছিলাম, বিস্ময়ে সামনে তাকাই । যদিও চোখ খোলা না খোলা সমান কথা ।


আরে এক ধরনের ধান । বিঘায় মাসে এক খন্দে হাজার মণ । আট-দশটা চালের ভাত রান্না করলে পাঁচ সাতজনের একটা পরিবার অনায়াশে এক ওয়াক্ত পেট ঠান্ডা রাখতে পারে। মহাবিষ্ময়কর ! এখন পৃথিবীতে কারা বাস করেঃ 
আন্ট্ায়েন্স অর্থাৎ অত্যাধুনিক মানুষ বাস করে। বর্তমান পৃথিবীতে নব্বই হাজার কোটি হোমো আনল্ট্রায়ে্স, তাদের গড় আয়ু পাঁচশ বছর, কোথাও গ্রামের চিহ্ন নেই, গোটা পৃথিবীটাই অবিচ্ছিন্ন শহর এবং কোথাও একশ তালার নিচে কোনো বিল্ডিং খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুপারসনিক বিমানগুলো আন্ট্রাসনিক মানে শব্দের গতির পাচগুণ/দশগুণ বেশি গতিতে চলে । বিগত সব সভ্যতাকে হার মানিয়ে নাম না জানা নতুন নতুন শহর, নতুন নতুন দেশ । সমস্যা একটাই...
কিসের সমস্যা? প্রশ্ন করি।

গ্লোবাল পলিটিক্স নিজেদেরই ধ্বংস করেবে। ইমব্যালানস্ড পাওয়ার পলিটিক্স ইজ এক্সারসাইজিং বাই ওয়ান কান্ট্রি এন্ড ওয়ান ম্যান। রাজনীতিতে হাইড এন্ড সিক থাকে। কিন্ত তাদের এই ডার্টি হাইড এন্ড সিক প্রায় সব দেশ ফলো করতে যেয়ে লেজে গোবরে করে ফেলবে। একসময় পৃথিবীতে জঙ্গি উত্থানের মূল কারণ এটাই ছিলো, সামনের সমস্যাও এটাই । তোমাদের সময়ের কথাই ভাবো । ওদের কাছে দেশ বা জনস্বার্থ বলে কি কিছু ছিলো? ক্ষমতায় টিকে থাকতে নেতা প্রয়োজনে নিজের এক চোখ অন্ধ করে দিতেও দ্বিধা করতো না। তোমার কথাই ভাবো...

হুম... একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে... এর কী কোনো স্থায়ী সমাধান নেই? 

নাই মানে! অবশ্যই আছে। পৃথিবী নিজেই কোনো অনিয়ম বেশিদিন সহ্য করে না, ও সবসময় প্রকৃতিগতভাবেই প্রাকৃতিক, ভাঙা-গড়া তার নিয়মেই চলেছে, চলছে, চলবে... 
জিম বলে, সপ্তম ভ্তর।

আমি নামতে যাই, অদৃশ্য কোনো ইঙ্গিতে পারি না। ডান আর বামের কাফ কাফ আমার দিকে এই প্রথম রেডিয়াম চোখে তাকিয়ে থাকে, যেন আমার আগাগোড়া স্ক্যান করে । এখন আমার কোনো ওজন আছে বলে মনে হয় না। এর কোনো মানে নেই। 

জিম বলে, পথিক নামো । তিনজন দাড়িয়ে কুর্ণিশ করে, জিম বলে, আলবিদা । 

মনে হলো আমি নভনীল থেকে উড়ে উড়ে নামছি। পেছনে তাকাতেই দেখি, ওরা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘুম.."ঘুম আর ঘুম.ত, 



কতোক্ষণ জানি না, ঘুম ভাঙে চোখ ধাধানো আলোয়। এখন আর চোখে ঘুম ঘুম ভাব নেই । রংধনুর সূত্রে শেষ রং অর্থাৎ আমি লাল আলোয় আলোকিত বায়ুযান নভনীল আর তিন অশরিরীর আগমনের অপেক্ষায় থাকি । কিন্ত কেউ-ই আর কখন-ই আসে না। আমার ওজন শুন্য । এখন নিশ্চিত, আমি স্থির নই অনবরত উড়তে শুরু করেছি এবং একাই... 

সম্ভবত আলোর কণা হয়ে গেছি। আমি আলোর গতিতে সবদিকে... সীমহীন মহাশূন্যে...অসীম অস্তিত্বহীনে...সর্বব্রই... শুধুই আমি...

No comments

FACEBOOK COMMENT