DEHLIJ

জুয়েল মাজহার

কালো জড়ুলের লোভ

জুয়েল মাজহার




চাকাটি গড়িয়ে গেল, ডুবে গেল থিকথিকে পাঁকে

তবু, শরীরের আগুন নেভাতে
হামামখানার দিকে পাগল ঋতুর যান ছোটে

টালির ছাদ আর ঝকমকে টিনের চালে
অশেষ অব্যয়সহ, স্ত্রী-পরাগসহ এসে
বসল ময়ূর


কালো-জড়ুল-আঁকা তোমার বাম স্তন থেকে
শ্বেত কেতুরের মতো স্ফটিকের দানা ঝরছে
আর, তবলার মতো নিজে থেকেই বেজে চলেছে রাত্রি


আয়না থেকে দৃশ্যটি পিছলে, গড়িয়ে গেল
রাত্রির অরূপ কুহরে



স্নায়ুপথে অখিল স্পন্দন আর, ওম শান্তি, ঘুমের সাঁতার!

গাগরি ভরার ছলে গোপন ঝোরার পথে নেমে
স্নায়ুবন ঢুঁড়ে তুমি পবিত্র-পাপের-ফুল
খোঁপায় পরেছ


অশেষ স্নানের শব্দ, মৃদু কেকারব...
এবার দু-জনে চলো ঢুকে পড়ি হামামখানায়
  




বাঘিনিকে



সোনার বাঘিনি, খোলো শয়নকুঠুরি
দাও সহজ প্রবেশ



তোমার চির-অভিযোজক, আশ্রয়ণীয় যোনির
স্বেদ ও শিশির থেকে তুমি কাউকে
বঞ্চিত কোরো না



অভ্রমে পড়া, অনভিজ্ঞ তরুণ বাঘের জন্য

রেখো কিছু রতি-স্বস্ত্যয়ন



বাঘটির জন্য তুমি অবারিত করে দাও
শয়নকুঠুরি, দয়াশীলা!



কেননা,

প্রতিসাম্যে জ্বলমান তোমার বিখ্যাত যোনি

প্রতিটি আলাভোলা তরুণ বাঘকে



পরম স্নানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে





অক্ষরের কালো বড়ি গিলে



‘‘আমার সঙ্গে আইস

তোমরা যেমন মাছ ধরিয়া থাক, তেমনই
আমি তোমাদের মানুষ ধরিতে শিখাইব।’’

–-- মথি ৪:১৮/বাইবেল




১.

প্রতিটি গাছের গোড়ায়

গোপনে কুড়াল রেখে আসে কাঠুরের দল;

রাত্রে পাতাকুড়ানির রূপ ধরে চুপে তারা আসে


হায়েনার কঠিন চোয়ালে

তৃণভোজীদের হাড় ভাঙার দূরাগত আওয়াজের মতন

অরণ্যে শব্দ করে চলেছে তাদের স-মিল;



যারা তৃণে ও তণ্ডুলে তৃপ্ত ছিল, তারা আজ নব ভোগ চায়;

তাদের দাঁত এখন কামড় বসাচ্ছে গাছের কোমরে

অসতর্ক সরল মেঘেদেরও লেহনে উদ্যত তারা



তারা আসছে গহন পাতালপথ খুঁড়ে :

মাটির নিচেকার লোহা ও আকরিকেও তাই

ছড়িয়ে পড়ছে ভয়তরঙ্গ



স্তব্ধতার প্রান্তরে চুপে ঢুকে পড়েছে ঘুংড়িকাশিপটু ছাগপাল



২.

শস্যের মাড়াই শুরু হয় নি এখনো। তার আগেই

গোলাঘরের পাশে মুখোশপরা কয়েকটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল



তাদের কোমরে ভুজালি আর হাতে তুষ ঝাড়ার বেলচা



‘কপোতের আকারে যিশুর উপর
নেমে আসবেন পরমপিতা ঈশ্বর’

----গ্রন্থপাঠ করে তবু এই কথা বৃথা মনে হলো

ঘাটেবাঁধা নৌকা ঠেলা বৃথা মনে হলো!


৩.

ওগো পিতা, খুল্লতাত, ওগো সনাতন

তোমরা বলেছ তাই গাছের গুঁড়ির কাছে

পুস্তকের পাতাগুলি খুলে-মেলে পড়তে বসেছি



সেখানে রয়েছে যত কঠিন সংকেত আর নষ্ট লেখাজোখা;

পড়তে গিয়ে ভুলে গেছি আমাদেরও ছিল কিছু ব্যক্তিগত মন



অক্ষরের কালো বড়ি গিলে

রোঁয়া ওঠা ঘাড় তুলে চলে যেতে দেখেছি যৌবন



বসন্ত নীরবে এসে দ্রুত চলে গেল

আদিপিতা-মাতাদের মতো

অমরতা চেয়ে-চেয়ে আমরাও হব জরদ্গব



৪.

এবং ধরো যে এই আজ দুপুরেও

ভারী ভারী পুথি-পাঁজি-গ্রন্থের আফিমে বুঁদ হ’য়ে

ঘুমোতে যাবার পর কত কিছু ঘটে গেল, কত কিছু হলো

আমাদের ডেকে গেল ঘুঘু তার আপন প্রলাপে;

তবু কোনো সাড়াই পেল না

ডাকল আকুল, তবু, আমাদের সাড়াই পেল না



স্বরের সুনামি তার ধীরে ধীরে ছড়াল বাতাসে

ঘুঘুটির বুকে ও গলায় কিছু ক্ষত ছিল। আমরা দেখি নি

আমরা বুঝি নি তার ব্যক্তিগত ভঙ্গিমা ও ভাষা;



৫.

জ্ঞানকাণ্ডবলে তবু আমরা ঢের হয়েছি ভাস্বর

ছায়াপথে ভেসে চলা আজগুবি নানা স্বর ডিকোড করেছি

আমরা জানি, আমাদের চারপাশে কত কত রয়েছে বিস্ময়



প্রাচীরের ওই পাশ থেকে কত সখা আর কংসমামা এল

ভিনগ্রহ থেকে কত ঢেউ এল, হেঁচকা টান এল

তবে কিনা আমাদের নজর এড়িয়ে কিছু অঘটনও হলো :



মাটি ফুঁড়ে, স্ত্রীলোকের জরায়ু ফাটিয়ে

আগুনে বাকলপোড়া গাছ থেকে নেমে

নলখাগড়াবন আর শেয়ালমুর্তার ঝোপ দু-পায়ে মাড়িয়ে

বজ্রদেবতার বিজুলিতে সদা ঝলকিত

সুরম্য প্রাকারঘেরা, ইট-দিয়ে-ঘেরা এক জঙ্গলের দিকে

ছুটে চলেছে জন্মদণ্ডিত, ভুখা আর মূক-মলিন

নেংটিপরা মানুষেরা



তারা প্রত্যেকেই কাঁধে করে বয়ে আনছে

আত্মবিনাশের ক্রুশ আর মড়াটানা চৌকি

তাদের সবার কোলে তিরবেঁধা মৃত কবুতর



৬.

গুটেনবার্গের মেশিনজরায়ু থেকে সদ্য-বের-হয়ে-আসা গ্রন্থেরা জানাল :



মরাটানা চোকির আবলুস কাঠের পাটাতনটিও

পশ্চিমাগত করাতকল থেকে চুরি করে আনা





৭.

গ্রন্থপাঠ শেষ করে চশমা নিভিয়ে দেখি, এ কী!

জ্ঞানমলে মাখামাখি নগ্ন-বিশীর্ণ-শৌচহীন

শুয়ে রয়েছেন আমাদের সকলের নিধিরাম পরম প্রপিতা;

তাঁর দুই অণ্ড ঘিরে ভনভন করছে মাছিরা


শিয়রে তখনও খোলা রয়েছে পুস্তক

No comments

FACEBOOK COMMENT